Thank you for trying Sticky AMP!!

চিকিৎসকের মৃত্যু ঘিরে রহস্য , অভিযোগ-উত্তেজনা

রাজন কর্মকার

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহকারী অধ্যাপকের মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। রাজন কর্মকার (৩৯) নামের ওই চিকিৎসকের মা, ভাই ও সহকর্মীদের অভিযোগ, তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন।

রাজনকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ তুলে তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেছেন তাঁর স্বজন ও গ্রামবাসী। তাঁদের অভিযোগের আঙুল রাজনের স্ত্রী কৃষ্ণা মজুমদারের দিকে। কৃষ্ণা নিজেও বিএসএমএমইউয়ের সহকারী অধ্যাপক, তাঁর বাবা খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার।

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল রোববার ভোরে মৃত অবস্থায় রাজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন কৃষ্ণা। রাজনের মৃত্যু স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক, তা নিয়ে রাজন ও কৃষ্ণার সহকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। অভিযোগ ওঠার পরে বিকেলে পুলিশ স্কয়ার হাসপাতাল থেকে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। তবে পুলিশ জানিয়েছে, নিহত ব্যক্তির শরীরে কোনো দাগ নেই। রাতে রাজনের মামা সুজন কর্মকার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। আর মন্ত্রী সাধন মজুমদার ও তাঁর মেয়ে কৃষ্ণা মজুমদারও অসুস্থ হয়ে গতকাল স্কয়ার হাসপাতালের পাশাপাশি দুটি কেবিনে একই চিকিৎসকের অধীনে ভর্তি হয়েছেন।

স্কয়ার হাসপাতালের পেছনে ইন্দিরা রোডের একটি ভবনের চারতলায় তিন বছর ধরে থাকতেন রাজন ও কৃষ্ণা দম্পতি। ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, নিয়মিত বাসা ভাড়া দিয়ে গেলেও থাকতেন না এই দম্পতি। আর কৃষ্ণার বাবা সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা আরও কম এখানে থাকতেন। মো. ইউনুস নামের একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে রাজন বাসায় ঢোকেন। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরে বেরিয়ে আধা ঘণ্টা পরে ফেরেন। রাত আনুমানিক তিনটার দিকে ওই বাসায় বড় একটি জিপগাড়ি নিয়ে আসেন কৃষ্ণা মজুমদার। ওই গাড়িটিকে নিরাপত্তাকর্মীরা ‘মন্ত্রীর গাড়ি’ (কৃষ্ণার বাবার ব্যবহৃত) হিসেবে জানেন। নিচে চালককে রেখে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যান কৃষ্ণা।

আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে কৃষ্ণা তাঁর আনা গাড়িটির চালককে ফোন করে দ্রুত আরেকজনকে নিয়ে ওপরে যেতে বলেন। গাড়িচালক চিৎকার করে নিরাপত্তাকর্মীদের ওপরে যেতে বলেন, লিফট চালু করতে বলেন। চালকের সঙ্গে ইউনুস রাজনের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখেন রাজন চিৎ হয়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছেন। কৃষ্ণা কাঁদছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন ‘কেন এমন হলো’। রাজনকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকেন কৃষ্ণা। ইউনুস ও চালক মিলে চিকিৎসক রাজনের সংজ্ঞাহীন দেহটি ধরে লিফটে নামিয়ে গাড়িতে তুলে দেন। এরপর তাঁরা হাসপাতালের দিকে চলে যান।

স্কয়ার হাসপাতাল থেকে রাজনের ফ্ল্যাট হেঁটে ১০ মিনিটের দুরত্বে। ওই হাসপাতাল থেকে দেওয়া মৃত্যুর সনদপত্রে মৃত্যুর সময় লেখা রয়েছে ভোররাত চারটা। এখানে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিক্ষোভ

রাজন কর্মকারের বাবা সুনিল কর্মকার ও মা খুকু রানী কর্মকার দুজনই ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তাঁরা বর্তমানে অবসরে। দুই ভাই ও এক বোনের সংসারে রাজন ছিলেন দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়।

রাজনের মৃত্যুকে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ দাবি করে এর বিচারের দাবিতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সড়ক আটকে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন রাজনের স্বজন ও গ্রামের মানুষ। রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে চৌমুহনী-মাইজদী মহাসড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। এসময় সড়কের দুই দিকে অসংখ্য যানবাহন আটকা পড়ে। পরে বেগমগঞ্জ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে প্রায় এক ঘন্টা পর অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ চলাকালে রাজনের মা খুকু রানী কর্মকার পাশের বাড়ি থেকে সড়কের ওপর এসে ‘ছেলে হত্যার’ বিচারের দাবিতে আহাজারি করতে থাকেন। তিনি এ সময় সড়কে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় উপস্থিত জনতা রাজনকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে বিচারের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।

মায়ের অভিযোগ

রাজনের মা খুকু রানী কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার রাত দুইটার দিকে তাঁর মুঠোফোনে পুত্রবধূ কৃষ্ণার ফোন আসে। রাগী স্বরে কৃষ্ণা তাঁকে বলেন, ‘আমি আপনাকে আর আপনার ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়াব।’ বলেই ফোন কেটে দেন। খুকু রানী এরপর ছেলে রাজনকে ফোন করেন। রাজন বলেন, ‘মা, তুমি চুপ করো। তুমি কোনো কথা বোলো না।’ রাজন এটা বলেই ফোন কেটে দেন। এরপর তিনি অনেকবার ছেলেকে ফোন করেও পাননি। পরে ভোররাত চারটার দিকে তাঁর ছোট ছেলে রাজিবের মুঠোফোনে রাজনের মৃত্যুর খবর আসে।

রাজনের ছোট ভাই রাজীব কর্মকার বলেন, ভোররাত চারটার দিকে তাঁর ভাইয়ের শ্যালিকা মুন্নি তাঁকে ফোন করে বলেন, ‘নিকটাত্মীয় কেউ ঢাকায় থাকলে হাসপাতালে পাঠান।’ এরপর মুন্নী তাঁদের আত্মীয় রাজেশ মজুমদারকে ফোনটি দিলে তিনি রাজীবকে ভাইয়ের মৃত্যুর কথা জানান।

রাজনের মা ও ভাই জানান, ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবে রাজনের সঙ্গে কৃষ্ণার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই তাঁদের দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। রাজনের গায়ে হাতও তুলতেন কৃষ্ণা। প্রায় দেড় বছর আগে কৃষ্ণার প্রচণ্ড মারধরে রাজনকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়। তখন তাঁকে আইসিইউতে নিতে হয়েছিল।
খুকু রানী কর্মকার দাবি করেন, তাঁর ছেলের বউ পরিকল্পিতভাবে তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে। তিনি এর বিচার চান।

বিভক্ত সহকর্মীরা
রাজন ছিলেন বিএসএমএমইউয়ের ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন হিসেবে তিনি নাম করেছিলেন বলে সহকর্মীরা জানান। তাঁর মৃত্যুর খবরে দন্ত চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির সদস্যরাও স্কয়ার হাসপাতালে ভিড় জমান। অন্যদিকে, কৃষ্ণা মজুমদার সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। রাজনের মৃত্যুর খবরে তাঁর সহকর্মীরাও হাসপাতালে ভিড় জমান। দুজনের সহকর্মীরা রাজনের মৃত্যুর বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন।

বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির মহাসচিব ও ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবীর বুলবুল স্কয়ার হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, অতীতের ঘটনাপ্রবাহ থেকে তাঁরা সন্দেহ করছেন, রাজনকে হত্যা করা হতে পারে। তাই তাঁরা এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন। আর রাজন যেহেতু সনাতন ধর্মের, তাই একবার সৎকার করা হলে আর মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্ভব নয়।

আবার হাসপাতালে ভিড় করা কৃষ্ণার কয়েকজন সহকর্মীর দাবি, রাজনের মৃত্যু যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে, তা নিয়ে অন্তত কোনো চিকিৎসকের সন্দেহ থাকা উচিত নয়। স্কয়ার হাসপাতালও তাঁকে স্বাভাবিক মৃত্যুর সনদই দিয়েছে। সন্ধ্যায় রাজনের লাশ সোহওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে আনার পরে সেখানে গিয়ে জড়ো হন রাজন ও কৃষ্ণার সহকর্মী চিকিৎসক ও স্বজনেরা। মর্গেও উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন রাজন বিএসএমএমইউয়ের পাশপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও বসতেন। বিএসএমএমইউয়ের ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর নোওয়াজেস আলী প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার রাতে রাজন ও তিনি সাত মসজিদ রোডের আল মানার হাসপাতালে একসঙ্গে অস্ত্রোপচার করেছেন। রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে রাজন গাড়িতে করে হাসপাতাল থেকে বের হন।

রাজন ও কৃষ্ণা দুজনেরই পরিচিত ওই হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেছেন, রোববার সকালে কৃষ্ণার সঙ্গে তাঁর কথা হয় ধানমন্ডিতে কৃষ্ণার বোনের বাসায়। তখন কৃষ্ণা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলনে, রাজন রাত পৌনে ১১টার দিকে বাসায় ফেরেন। কৃষ্ণার বাবার (খাদ্যমন্ত্রী) রক্তচাপ পরীক্ষা করেন। রাজন রাতে বাসায় খাননি। রাতে ঘুমানোর একপর্যায়ে কৃষ্ণা রাজনকে ডেকে কোনো সাড়া পাননি। পরীক্ষা করে রক্তনালির কোনো স্পন্দন পাননি। বিএসএমএমইউয়ের টেলিফোন নির্দেশিকায় দেওয়া কৃষ্ণা মজুমদারের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

মামলা প্রক্রিয়াধীন

বিকেলে স্কয়ার হাসপাতালে শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুর কালাম আজাদসহ কয়েকজন কর্মকর্তা এসে রাজনের লাশ হেফাজতে নেন। লাশের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।


আবুল কালাম আজাদ বলেন, কেবল স্বজন ও সহকর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতেই তাঁরা লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাচ্ছেন। পাশপাশি নিহত ব্যক্তির ভিসেরা পরীক্ষার জন্যও পাঠানো হবে। তবে সুরতহালে নিহত ব্যক্তির শরীরে কোনো সন্দেহজনক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

রাতে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, রাজনের মামা সুজন থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। যেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন, রাজনের মৃত্যু নিয়ে তাঁর সন্দেহ আছে। তবে সন্দেহভাজন হিসেবে কারও নাম দেওয়া নেই। এর জন্য তাঁরা রাজনের ময়নাতদন্ত করছেন। এ বিষয়ে একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন। তবে কী মামলা হচ্ছে, সে বিষয়টি রাতে স্পষ্ট করেনি পুলিশ।