Thank you for trying Sticky AMP!!

ছোট নেতাদেরও অগাধ সম্পদ

ফরিদপুরের স্থানীয় রাজনীতিকেরা বলছেন, কেবল বরকত–রুবেলই নন, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের প্রশ্রয়ে ফরিদপুরের শতাধিক নেতা অবৈধভাবে কোটিপতি হয়েছেন।

পুরোনো জেলা শহর ফরিদপুর। এই শহরে থেকে এখানেই টেন্ডারবাজি, দখল, তদবির, চাঁদাবাজি আর কমিশন–বাণিজ্য করে যে হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন সম্ভব, তা জানা গেল দুই ভাই বরকত ও রুবেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর। ফরিদপুরের স্থানীয় রাজনীতিকেরা বলছেন, কেবল ওই দুই ভাই–ই নন, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের প্রশ্রয়ে ফরিদপুরের শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা অবৈধভাবে কোটিপতি হয়েছেন। চুনোপুঁটি নেতাদেরও জমি, বাড়ি, গাড়ির বহর দেখে অবাক হতে হয়।

আড়াই হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় গত বুধবার ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ মোট ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। ওই দুই ভাইয়ের পাশাপাশি অভিযোগপত্রভুক্ত বাকি আট আসামিও গত এক দশকে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা, আওয়ামী লীগ নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে তাঁদের এ সম্পদের বিষয়ে জানা যায়।

জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা ব্যাপক লুটপাটতন্ত্র কায়েমের জন্য খন্দকার মোশাররফকেই দায়ী করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে সময় ফরিদপুরে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষ তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারেনি। যে যা ইচ্ছা তাই করেছেন, যেভাবে পেরেছেন সেভাবে টাকা রোজগার করেছেন। এ বিষয়টি আমাকে দীর্ঘদিন ধরে পীড়া দিয়েছে। আমিও তাঁদের সঙ্গে ছিলাম। আমিও চেষ্টা করেছিলাম এই চক্র থেকে বের হয়ে আসার জন্য, কিন্তু আমি এই অপশক্তির কারণে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে আসতে পারিনি।’

তবে খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল ফোন করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা ফরিদপুরে দুর্নীতি–লুটপাট করেছেন, আমার নাম ব্যবহার করেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমি কখনোই যুক্ত ছিলাম না। আমি পুরোনো আওয়ামী লীগ নেতাদের দল থেকে বের করে দিয়েছি, এ অভিযোগ কেউ করতে পারবেন না। যাঁরা দুর্নীতি করেছেন অবশ্যই তাঁদের বিচার হতে হবে। কিন্তু আমাকে জড়িয়ে যেসব ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা হচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি কোনো কাদা–ছোড়াছুড়ির মধ্যে যেতে চাই না। তবে আমাকে জড়িয়ে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, আমি তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

টাকা নিতেন বাবর

অভিযোগপত্রে বরকত-রুবেলের পরেই তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে খন্দকার মোহতেসাম হোসেন বাবরকে। তিনি সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-৩ আসনের সাংসদ মোশাররফ হোসেনের ভাই। ৬৩ বছরের বাবর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। ২০০৯ সালে খন্দকার মোশাররফ মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ফরিদপুর নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন।

আদালতে দেওয়া বরকত ও রুবেলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাবরের সঙ্গে তাঁদের লেনদেনের অনেক তথ্য এসেছে। জবানবন্দিতে রুবেল বাবরকে ‘বাবর চাচা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘জেলা পরিষদ অডিটরিয়াম করার কাজ নেওয়ার জন্য বাবর চাচাকে ১ কোটি টাকা দিয়েছি। উপজেলা অ্যাডমিনেস্ট্রশন ভবন করার ব্যাপারে বাবর চাচা ৪০ লাখ নিয়েছেন। পাট গবেষণা মার্কেটের ব্যাপারে কাজ নেওয়া বাবদ বাবর চাচাকে আরও ৪০ লাখ টাকা দিছি।’

স্থানীয়রা বলছেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ভাই মোশাররফের পাশে ছিলেন না বাবর। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিপুল ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে খন্দকার মোশাররফ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে ওই দুই বছর তাঁর ভাই খন্দকার মোহতেসাম হোসেন ৫০ সিসির একটি মোটরসাইকেল চালিয়ে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতেন। ২০০৯ সালে খন্দকার মোশাররফ মন্ত্রী হওয়ার পর সেই বাবর রাতারাতি জেলা আওয়ামী লীগকে গ্রাস করে, লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে। এর ফলে স্থানীয় মানুষের মনে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ৫০ সিসি মোটরসাইকেল চালিয়ে বেড়ানো বাবর ৫ একর জমির ওপরে অন্তত ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিলাসবহুল প্রাসাদ গড়েছেন।

মোহতেসাম বাববের একটি মুরগির খামার ছিল। সেই খামারের কর্মচারী বিল্লাল হোসেন ও জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক মোকাররম মিয়ার মাধ্যমে তিনি টেন্ডারবাজি শুরু করেন। পুরোনো নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে অনেকগুলো পকেট কমিটি করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে কে কোন পদে থাকবেন, কাকে বাদ দেওয়া হবে, কাকে নেওয়া হবে, তা ঠিক করে দিতেন তিনি।

২০১৫ সালের পর রাজনীতি থেকে মোকাররম মিয়া ও মন্ত্রীর এপিএস সত্যজিৎ মুখার্জী অপসারিত হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে আবির্ভাব ঘটে বরকত ও রুবেলের। মন্ত্রী মোশাররফের এপিএস হন এ এইচ এম ফোয়াদ। টেন্ডার পাইয়ে দিতে বরকত-রুবেলের কাছ থেকেও টাকা নিতেন বাবর।

ফরিদপুর সদরের তাম্বুলখানা মৌজা, সাইবেরিয়া মৌজাসহ কয়েকটি এলাকায় তাঁর বিপুল সম্পদের কথা জানা যায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায়ও তাঁর সম্পদ ও বিনিয়োগ রয়েছে।

‘ফিফটিন পারসেন্ট’ ফোয়াদ

জেলা যুবলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক এ এইচ এম ফোয়াদ ছিলেন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এপিএস। এলজিইডি বাদে পিডব্লিউডি, পিডিবি, পাউবো, শিক্ষা প্রকৌশল, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, সড়ক বিভাগ অন্য সরকারি দপ্তরগুলোয় ঠিকাদারি কাজের জন্য ফোয়াদকে ১৫ শতাংশ হারে কমিশন দিতে হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলায় তাঁর একটি ‘হেলমেট বাহিনী’ রয়েছে। যাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ফরিদপুর শহরের চরকমলাপুরে সুমন টাওয়ারে তাঁর পাঁচটি ফ্ল্যাট, ঝিলটুলী মহল্লার জামান টাওয়ারের ১০ম ও ১১তম তলায় তাঁর দুটি ফ্ল্যাট, ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে একটি ও সিদ্ধেশ্বরীতে আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে জানা যায়। এ ছাড়া তাঁর জমিও রয়েছে প্রচুর।


লেবীর লোভী হয়ে ওঠা

ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার ওরফে লেবীর বাবা প্রয়াত খন্দকার আমিনুর রহমান ওরফে মজনু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর ছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে টেন্ডারবাজি, জমি দখলে যুক্ত হন লেবী। ফরিদপুর শহরে লেবীর কয়েকটি ফ্ল্যাট, বিপুল জমি এবং ঢাকায় তিনটি বাড়ির কথা জানা যায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। আলিয়াবাদ ইউনিয়নের সব সালিস করতেন তিনি। গজারিয়া হাট নিজের নামে ইজারা নিয়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, লেবী আজন্ম আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন। তবে ২০০৯ সালে খন্দকার মোশাররফ মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বরকত, রুবেল, ফোয়াদের সঙ্গে লেবীও কেউকেটা হয়ে ওঠেন।

সমাবেশে লোক দিয়ে বড়লোক

খন্দকার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুর শহরসহ আশপাশের যে জায়গায় সভা–সমাবেশ করতেন সেখানে আসিবুর রহমান ওরফে ফারহান ও ফাহাদ বিন ফাইন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের নিয়ে যেতেন স্লোগান দেওয়ার জন্য।

পরে ফারহান শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফাইন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ফারহান পূর্ব খাবাসপুরকেন্দ্রিক একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। এই বাহিনীর সদস্যরা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিলেন। ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে নিহত হন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক নার্স। এ ঘটনার সঙ্গে ফারহানের বাহিনী জড়িত, বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি আত্মগোপন করেন। ঢাকার মিরপুরে ফারহানের চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ফরিদপুর শহরতলির বিলমাহমুদপুর এলাকায় দুই জায়গায় তাঁর প্রায় দুই একর জায়গা রয়েছে। শহরে তিনি একটি চীনা খাবারের রেস্তোরাঁও দিয়েছেন। শহরের গোয়ালচামট ওগেরদা ইউনিয়নের বাখুন্ডাতে ৪ একর জমি কিনেছেন। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার দক্ষিণে পৌরসভার জায়গা ইজারা নিয়ে দোতলা বাড়ি করেছেন।

আর ফাহাদ বিন ফাইন শহরে অন্তত পাঁচটি ফ্ল্যাটের মালিক। ডিজিটাল প্রেস ও ফাহিমা কনস্ট্রাকশন নামে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি বিএডিসি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিদ্যুৎ অফিসে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন

এ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ আলী মিনার, শহর যুবলীগের সাবেক দুই যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল হাসান ডেভিড ও তরিকুল ইসলাম নাসিম ছিলেন ফোয়াদের হেলমেট বাহিনীর প্রধান নেতা। এঁদের দিয়ে সমালোচনাকারী, বিরোধীতাকারীদের শায়েস্তা করা হতো। তাঁরাও বিপুল সম্পদের মালিক।

এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন বরকত, রুবেল, লেবী ও ফারহান। বাকিদের গ্রেপ্তার করা নিয়ে পুলিশের দৃশ্যমান তেমন উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলিমাজ্জামান বলেন, ‘মানি লন্ডারিং মামলায় চার্জশিট হওয়ার আগে মোহতেসাম হোসেন বাবরের নামে কোনো মামলা ছিল না। এ জন্য তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের কোনো উদ্যোগ ছিল না।’ পলাতক বাকি পাঁচ আসামির বিষয়ে এসপি বলেন, ‘ওই পাঁচ আসামির সবার নামে একাধিক মামলা রয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। একবার শুনেছিলাম ফাইনকে ধুলদি এলাকার একটি পার্কে দেখা গিয়েছিল। খবর পাওয়ামাত্রই ফোর্স পাঠানো হয়। কিন্তু গ্রেপ্তার করা যায়নি। ডেভিড তাঁর বাবার মৃত্যুর পর জানাজায় অংশ নিতে এসেছিলেন। তিনি যে জানাজায় আসবেন, এ তথ্য আমাদের কাছে ছিল না।’