Thank you for trying Sticky AMP!!

জুয়ার টাকায় জৌলুশ ক্লাবে, খেলায় মনোযোগ নেই

প্রথম আলো ফাইল ছবি।

একটা সময় ক্লাবগুলো ছিল শুধুই খেলাকেন্দ্রিক। ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারীর মতো দলগুলো ঢাকার মাঠ কাঁপিয়েছে ফুটবল কিংবা হকি দিয়ে। এখন এই ক্লাবগুলোর বড় অংশেরই জুয়ার টাকায় জৌলুশ বেড়েছে, কিন্তু মাঠের খেলায় আর মনোযোগ নেই।

 বুধবার র‍্যাব অভিযান চালিয়ে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ সিলগালা করে দেয়। তবে বিষয়টি এমন নয় যে ওই দিন কিংবা দিন কয়েক আগে প্রথম ক্যাসিনো চালু হয়েছে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায়। পাঁচ–ছয় বছর ধরেই এই চারটি ক্লাবসহ মোহামেডান ও ব্রাদার্সে ক্যাসিনো ব্যবসা চলে আসছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, খেলাসংশ্লিষ্ট লোকজন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের একাধিক সূত্র বলেছে, ক্যাসিনোগুলো ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী (সম্রাট), সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া এবং এ কে এম মমিনুল হক (সাঈদ) এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন শীর্ষ নেতা চালাতেন। তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন এবং ক্লাবগুলোর কাজকর্ম নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না—এমনটাই মনে করে আসছিলেন সবাই।

গতকাল বৃহস্পতিবার খেলোয়াড়, ক্লাব কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। কীভাবে ক্লাবগুলো ঘিরে খেলার বদলে জুয়া মুখ্য হয়ে উঠল, সে বিষয়ে কথা বলেছেন তাঁরা। ঢাকার প্রাচীন একটি ক্লাবের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ক্লাবগুলোয় জুয়ার প্রচলন বরাবরই ছিল। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে হাউজি খেলা হতো। ওই টাকায় ক্লাবের দৈনন্দিন খরচা চলত। জুয়াটা রমরমা হয়ে উঠতে শুরু করে নব্বইয়ের দশক থেকে। ক্লাবগুলো তখন মাত্র মতিঝিল এলাকায় এসেছে। খেলাধুলার খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনুদানের টাকায় ক্লাবগুলো আর চলতে পারছিল না। তখনই একটি দুষ্ট চক্র ক্লাবে ঢুকে পড়ে। তারা ক্লাবের ঘর ভাড়া নিয়ে ওয়ান–টেন (ছোট তির ছুড়ে মারার খেলা) ও রামি (তাসের খেলা) নামের খেলা চালু করে। প্রতি রাতে ক্লাবগুলোকে এরা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিত। যারা জুয়ার আসর বসাত, তারা রাজনৈতিক নেতা, মহল্লার মাস্তান ও পুলিশকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিত।

ক্লাবপাড়ায় এই দুটি খেলার টাকা নিয়ে হাঙ্গামার ঘটনা বাড়তে থাকে। আরামবাগ ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবে দুটি খুন হয়। এরপর ওয়ান–টেন খেলা বন্ধ করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারও ক্লাবগুলো জুয়ার জন্য ঘর ভাড়া দিতে শুরু করে। প্রথম কয়েক বছর ওয়ান–টেন ও রামি চলতে থাকে। সাত–আট বছর আগে ক্লাবগুলো কলাবাগান ক্লাবের আদলে আন্তর্জাতিক মানের ক্যাসিনো চালুর উদ্যোগ নেয়।

কলাবাগান ক্লাবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্যাসিনো বন্ধ হয়ে যায়। তবে সেখানে যাতায়াত ছিল এমন একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, কলাবাগানে স্লট মেশিন জুয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের বোর্ড, নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী–পুরুষদের নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ক্লাবগুলোয় বাকারা (তাসের খেলা) নামের একটা খেলা হতো, পরে যুক্ত হয় রুলেট (চাকার মতো বোর্ড) এবং আরও কয়েকটি খেলা। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক নাজমুল করিম ওরফে টিঙ্কু। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মোহাম্মদপুরের ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম ওরফে সেন্টু। এখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি, পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল। নাজমুল করিম মারা যাওয়ার পর শফিকুল ইসলাম একাই টাকাপয়সা হস্তগত করায় মহল্লার রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের সঙ্গে ঝগড়া–বিবাদ শুরু হয়। এর সমাধান না হওয়ায় ক্লাবটি একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন কলাবাগান ক্লাবের আয় ছিল প্রায় কোটি টাকা। গতকাল চেষ্টা করেও শফিকুলের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ফুটবল খেলোয়াড় ও ক্লাব সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, কলাবাগান ক্লাবের আদলে প্রথমে ভিক্টোরিয়া ও পরে একে একে ওয়ান্ডারার্স, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা, মোহামেডান, আরামবাগে স্লট মেশিন বসে। আগে হাউজির জন্য যেখানে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘর ভাড়া পেত ক্লাবগুলো, সেখানে প্রতি রাতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছে। তাই খেলার বদলে জুয়া মুখ্য হয়ে উঠেছে।

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের ডিরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের এই উদ্যোগকে তাঁরা স্বাগত জানান। বুধবার র‍্যাব অভিযান চালাচ্ছে, খবর পেয়েই তিনি মোহামেডানের যে হলরুমে ক্যাসিনো ছিল, সেখান থেকে জুয়ার সরঞ্জাম বের করে তালা দিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক চাপের মুখে তিনি ঘর ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পুরানা পল্টনের কালভার্ট রোডের একটি ক্যাসিনোয় তাঁরা অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। মদ ও ফেনসিডিলের বোতল উদ্ধার করা হয়েছিল সেখান থেকে। তাঁরা পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন। ওই ক্যাসিনোর মালিক ছিলেন ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে নানা রকম আলোচনা হয়। কিন্তু ওই ক্যাসিনো আর চালু হয়নি। তবে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন অন্য ক্লাবগুলোয় ক্যাসিনো চলছিল।

খেলার যা অবস্থা

ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব একসময় দেশের অন্যতম ফুটবল ক্লাব ছিল এবং প্রথম বিভাগে খেলত। তাদের খেলা এখন পড়ে গেছে। তারা রয়ে যায় পেশাদার ফুটবল লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে। একসময় অনেক নতুন খেলোয়াড় তৈরি হতো, এখন খেলার রাস্তায় নেই ক্লাবটি।

ওয়ান্ডারার্স পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ঢাকার ফুটবলে পরাশক্তি ছিল। শীর্ষ ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। বড় বড় অনেক ফুটবলার খেলতেন এই ক্লাবে। তবে অনেক বছর ধরেই ওয়ান্ডারার্স দেশের ফুটবলে আর আলোচনায় নেই। শীর্ষ লিগে তো নয়ই, পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরেও খেলে না।

ওয়ারী দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ আগে অনেক খেলাই খেলত ক্লাবটি। ফুটবলে এই ক্লাব এখন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে খেলে। অথচ একসময় ঢাকার ফুটবলে ‘ওয়ারী আইলো’ স্লোগান ছিল। ভিক্টোরিয়ারও প্রায় একই অবস্থা। ক্লাবটি ক্রিকেটের প্রিমিয়ার লিগে খেললেও ফুটবলে শীর্ষ স্তরে নেই অনেক বছর। তারা এখন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে খেলে। কিন্তু তারা কোনো আলোচনায় নেই। হকিতে ক্লাবটি খেলে প্রিমিয়ারে লিগে।

আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তৈরি হওয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের মূল কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছে জুয়ার আয়োজন করা।

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক দুঃখ করে বলছিলেন, বিশ্বের কোথাও কি এমন দেশ আছে, যেখানে খেলা ও খেলোয়াড়দের পৃষ্ঠপোষকতা করতে জুয়ার আয়োজন করা হয়! এটা ভীষণ লজ্জার।