Thank you for trying Sticky AMP!!

ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র: তাঁদের হাতের মুঠোয় ছিল ইসির সার্ভার

প্রতীকী ছবি

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন বিভাগের সার্ভারের (তথ্যভান্ডার) সব তথ্য ছিল জালিয়াত চক্রের হাতের মুঠোয়। তারা যখন-তখন এই জাতীয় সার্ভারে প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ এবং কারও নামে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে আঙুলের ছাপ ও ছবিসহ তা সার্ভারে যুক্ত করে দিতে পারত। আর এই কাজটা করতেন জালিয়াত চক্রের সদস্য চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুক।

গত বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার হন মোস্তফা ফারুক। এরপর​ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ তথ্য পায় পুলিশ। কেবল তা-ই নয়, মোস্তফার বাসা থেকে উদ্ধার করা তাঁর ব্যক্তিগত ল্যাপটপ ও তিনটি পেনড্রাইভে পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম ও আশপাশের জেলার ভোটার তালিকা, যা জাতীয় সার্ভার থেকে ডাউনলোড করা হয়েছিল। তাঁর বাসা থেকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ডেটা এন্ট্রির কাজে ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, মডেম, আঙুলের ​ছাপ নেওয়ার তিনটি সিগনেচার প্যাডসহ (যার গায়ে রাউজান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা লেখা) এনআইডি তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

 মোস্তফা ইসির অস্থায়ী কর্মী। ডেটা এন্ট্রির কাজ করতেন। তাঁর কাছে জাতীয় সার্ভারে প্রবেশের পাসওয়ার্ড ছিল। তিনি জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গত পাঁচ বছরে সার্ভারে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তির নামে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) করেছেন বলে​ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এ-সংক্রান্ত মামলার তদন্তকারী সংস্থা চট্টগ্রাম পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের ধারণা, এই সংখ্যা আরও বেশি হবে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই জালিয়াত চক্র ভুয়া এনআইডি তৈরির ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির তথ্য ব্যবহার করত। তারা মৃত ব্যক্তির ছবি ও আঙুলের ছাপ পাল্টে দিয়ে বাকি তথ্য ঠিক রেখে সেটা জাতীয় সার্ভারে যুক্ত করে (আপলোড) দিত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এখন তা যাচাই-বাছাই চলছে।

এই জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যুক্ত চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নালসহ তিনজনকে গত সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে অস্থায়ী কর্মী মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

চট্টগ্রাম পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এনআইডি জালিয়াতি করে আসছে এই চক্র। চক্রের হোতা মোস্তফা নিজেই এনআইডি সার্ভারে আপলোডের (‍তথ্য, ছবি ও আঙুলের ছাপ) কাজ করতেন। রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে দালালদের মাধ্যমে তাঁর কাছে নিয়ে আসতেন ইসির আরেক কর্মচারী জয়নাল আবেদীন। এই চক্রের সঙ্গে ইসির কিছু কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে চক্রটি ইসির সার্ভার নিয়ে নয়ছয় করতে পেরেছে।

জালিয়াত চক্রের​ যোগাযোগ ঢাকায়ও

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া জানান, ইসির সার্ভারে কীভাবে প্রবেশ করতেন এবং এর সঙ্গে জড়িত অন্যদের শনাক্ত করতে মোস্তফাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার আদালত তাঁর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, ঢাকায় ইসির কার্যালয়েও মোস্তফার যাতায়াত ছিল। সার্ভারে প্রবেশের পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে যাবতীয় তথ্য তাঁর নখদর্পণে। তিনি নিজেই ইসির সার্ভারে তথ্য আপলোড করতে পারেন। আবার অনেক সময় এনআইডির তথ্য তৈরি করে তা ঢাকায় দুই কর্মীকে পাঠাতেন এবং তাঁরা তা সার্ভারে আপলোড করতেন। ওই দুজন ঢাকায় জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের অধীনে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া। তাঁদের সঙ্গে মোস্তফার ভালো পরিচয় রয়েছে। একেকটি এনআইডি তৈরির জন্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিতেন মোস্তফা। এই টাকার ভাগ যাঁরা পেতেন, তাঁদের নামও বলেছেন তদন্ত সংস্থাকে।

মোস্তফা জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে আসছেন। চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমেও তিনি চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের অধীনে কাজ করেছেন।

গাফি​লতির জের

চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন থেকে রোহিঙ্গারা নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে ভোটার হচ্ছেন। ভুয়া এনআইডি দিয়ে জঙ্গিরা বাসা ভাড়া নিচ্ছেন। এর সঙ্গে জড়িত ইসির কোনো কোনো মাঠকর্মী। ইসি কর্মকর্তাদের অনেকে নিজেদের পাসওয়ার্ড অফিস সহকারী ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের দিয়ে রেখেছেন। এমন অভিযোগ অনেক দিন থেকে শোনা গেলেও ইসি এত দিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের ধরতে পুলিশকে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান ইসি সচিবালয়ের উপসচিব মো. খোরশেদ আলম। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ দিন আগে তাঁরা ইসির সার্ভারে যাতে কেউ কিছু করতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিয়েছেন।

পাঁচ বছর ধরে জালিয়াতি চলছে, এত দিন কেন সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হলো না—এ প্রশ্নের জবাবে খোরশেদ আলম বলেন, যখনই জানা গেছে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরীর মতে, ইসির গাফিলতির জেরে এমন জালিয়াত চক্র গড়ে উঠেছে। এর পেছনে বড় কর্মকর্তাদের কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারেন। তিনি বলেন, এনআইডির সার্ভারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে এটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি তৈরি করবে।