Thank you for trying Sticky AMP!!

পর্বতারোহী রেশমাকে যেভাবে গাড়িচাপা দিয়ে পালান ব্যাংক কর্মকর্তা

রেশমা আক্তার রত্না

পর্বতারোহী রেশমা আক্তার ওরফে রত্নাকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এস এম দারুস সালাম। তিনি বলেছেন, ওই ঘটনার পর লোকজনের ভয়ে তিনি দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে চলে যান।

গত বছরের ৭ আগস্ট সকাল পৌনে নয়টার দিকে সংসদ ভবন এলাকায় চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনের সড়কে নিহত হন সাইকেল আরোহী রেশমা। রাজধানীর একটি স্কুলে শিক্ষকতাও করতেন তিনি।

দারুস সালাম বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম)। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তিনি । কাল সোমবার মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

জবানবন্দিতে দারুস সালাম বলেন, নিজের গাড়ি নিয়ে যখন ক্রিসেন্ট লেকের পাশের সড়কে ঢোকেন, তখন সামনে আরেকটি গাড়ি ছিল। হঠাৎ করে ওই গাড়িটি গতি কমিয়ে সড়কের বাঁ পাশে চলে যায়। তখন তাঁর গাড়ির সামনে চলে আসেন সাইকেল আরোহী তরুণী। তাঁর গাড়ির সঙ্গে সাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওই তরুণী ছিটকে পড়েন। লোকজনের ভয়ে তিনি দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে চলে যান।

রেশমাকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গত বছরের ২৭ আগস্ট বাংলাদেশের ব্যাংকের ডিজিএম এস এম দারুস সালাম গ্রেপ্তার হন। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। অবশ্য গত বছরের ৮ নভেম্বর তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

ওই মামলায় গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা দারুস সালামের নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় শেরেবাংলা নগর থানা–পুলিশ। মামলা থেকে অপর আসামি নাঈমকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন। সোমবার মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

অবশ্য আসামি দারুস সালামের পক্ষে তাঁর আইনজীবীরা আদালতের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, এ ঘটনার সঙ্গে তাঁর মক্কেল জড়িত নন। নিহত পর্বতারোহী রেশমার দুলাভাই মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের একটিই চাওয়া, মামলাটি যেন দ্রুত নিষ্পত্তি করে দোষীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।

রেশমা আক্তার রত্না

কীভাবে রেশমাকে গাড়িচাপা দেওয়া হয়

পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এবং মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন রেশমা। সেদিন সকালে সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনের সড়ক ধরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তখন উড়োজাহাজ ক্রসিং থেকে গণভবনের দিকে দুটি কালো বা ধূসর মাইক্রোবাস প্রবেশ করে। সড়ক তখন ফাঁকা ছিল। এই সুযোগে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে পেছন থেকে রেশমা আক্তারকে ধাক্কা দিয়ে চলে যান চালক। দুটি গাড়ির কোন গাড়িটি রেশমাকে ধাক্কা দিয়েছিল, তা যাচাই করার জন্য প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়। প্রথমে নাঈম নামের একজন চালককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে গ্রেপ্তার করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা এস এম দারুস সালামকে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, গাড়িচাপায় নিহত রেশমা আক্তারের মামলা তদন্তের সময় ঘটনাস্থলের আশপাশের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে নাঈম (২৭) নামের একজন গাড়িচালককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

দুর্ঘটনার পর সড়কের ওপর পড়েছিল রেশমার সাইকেলটি

একটি গাড়িও জব্দ করা হয় তখন। তবে তদন্তকালে ভিডিও ফুটেজের তথ্য পর্যালোচনায় উঠে আসে, সেদিন (গত ৭ আগস্ট) সংসদ ভবন এলাকায় উড়োজাহাজ ক্রসিং থেকে প্রায় একই সময়ে ধূসর বা কালো রঙের দুটি মাইক্রোবাস গণভবন ক্রসিংয়ের দিকে ছুটে যায়। লেক রোড তখন ফাঁকা ছিল। বেপরোয়া গতি নিয়ে যাওয়ার সময় চন্দ্রিমা উদ্যানের ক্রিসেন্ট লেকের পাশে রেশমা আক্তার সাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি রাস্তার বাঁ পাশ থেকে ডানে যাওয়ার জন্য ইউটার্ন নেন। তখন রেশমার সাইকেলের পেছন ধূসর বা কালো রঙের গাড়িটি ব্রেক কষে বাঁ পাশে চেপে যায়। তবে কালো বা ধূসর রঙের আরেকটি গাড়ি ডান পাশ দিয়ে সামনে যাওয়ার সময় রেশমাকে ধাক্কা দেয়। কোন গাড়িটি রেশমাকে ধাক্কা দেয়, তা তাৎক্ষণিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব না হওয়ায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য যাচাই–বাছাই করা হয়। ভিডিও ফুটেজের আলোকে বিআরটিএর ওয়েবসাইটে এনসিপি৮১ চেচিস–সংবলিত যেসব মোটরযান নিবন্ধন হয়েছে, তার তালিকা যাচাই–বাছাই করা হয়। পরে রেশমাকে ধাক্কা দেওয়া গাড়ির চালক দারুস সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মোবারক আলী প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের ভিডিও ফুটেজের তথ্য পর্যালোচনা করে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় নাঈমকে। পরে গ্রেপ্তার করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে। তিনি রেশমাকে গাড়িচাপা দেওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেন। আদালতের কাছেও তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।

মামলার নথিপত্রের তথ্য বলছে, যে গাড়ির ধাক্কায় রেশমা আক্তার মারা যান, সেই টয়োটে ব্র্যান্ডের মাইক্রোবাসটি জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও জব্দ করা হয়েছে ওই গাড়ির সিলভার রঙের স্টিলের বাম্পার।

প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে যা বলেছেন

পর্বতারোহী রেশমাকে গাড়িচাপা দেওয়ার মামলায় ২০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের কাছে দেওয়া ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে কনস্টেবল শরিফুল ইসলাম উল্লেখ করেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। সকাল ৮টা ৫০ মিনিট থেকে ৯টা ২ মিনিটের মধ্যে চন্দ্রিমা উদ্যান লেক সেতুর দক্ষিণ মাথার প্রধান সড়কে একটি শব্দ শুনতে পান। সঙ্গে সঙ্গে একজন পথচারী ওই গাড়িটি ধরার জন্য চিৎকার দেন। চিৎকার শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনিসহ অন্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তখন একজন নারীকে রক্তাক্ত অবস্থায় সেখানে পড়ে থাকতে দেখেন। একটি কালো ধূসর রঙের মাইক্রোবাসকে দ্রুতবেগে চলে যেতে দেখেন। পরে এক পুলিশ কনস্টেবল রেশমাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

ব্যাংক কর্মকর্তা এস এম দারুস সালাম

ব্যাংক কর্মকর্তার গাড়ি জব্দ

রেশমা আক্তারের মৃত্যুর ঘটনায় মামলার আলামত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা এস এম দারুস সালামের গাড়িটি সাভার থেকে জব্দ করা হয়।

দারুস সালামের পূর্বপরিচিত হযরত আলী নামের এক ব্যক্তি এই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত একজন সাক্ষী। পুলিশের কাছে দেওয়া ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন, পেশায় তিনি একজন ঠিকাদার। সাভারের হেমায়েতপুরে দারুস সালাম একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। গত বছরের ১৬ আগস্ট দারুস সালাম তাঁকে ফোন দেন। জানতে চান, তাঁর কোনো পরিচিত গাড়ির মেকানিক আছে কি না? জবাবে তিনি জানান, তাঁর একজন পরিচিত বন্ধু আছেন, যিনি একটি গাড়ির সার্ভিস সেন্টারের মালিক। পরে দারুস সালাম তাঁর গাড়ির সামনের বনেট, লুকিং গ্লাস, সামনের বাম্পার ও ভাঙা উইন্ডশিল্ড নিয়ে আসেন। হযরত আলী তাঁর বন্ধু রনির গাড়ির সার্ভিস সেন্টারে গাড়িটি নিয়ে যান। তাঁর বন্ধু রনি গাড়িটি মেরামত করে দেন। পরে তিনি জানতে পারেন, দারুস সালামের গাড়িটি চন্দ্রিমা এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল।