Thank you for trying Sticky AMP!!

বাঁশখালীতে পুলিশের ‘অসহিষ্ণু আচরণ’ নিয়ে প্রশ্ন

চট্টগ্রাম জেলার মানচিত্র

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক বিক্ষোভ দমাতে পুলিশের গুলি চালানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর শুরুতেই গুলি না চালিয়ে ধাপে ধাপে এগোনো উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে পুলিশের আচরণ অসহিষ্ণু বলে মত দিলেন তাঁরা।

গুলিবিদ্ধ শ্রমিকেরা অনেকে বলেছেন, পুলিশ শুরুতেই তাঁদের ওপর গুলি চালাবে এমন ধারণা ছিল না।

তবে পুলিশের দাবি, বিক্ষোভকারীদের কয়েকজনের হাতে অস্ত্র ছিল। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতি করেছে। কিন্তু দুই দিনে কোনো অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের কোনো সদস্যও গুলিতে আহত হননি।

কোন পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি চালাতে পারে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য প্রথমে পুলিশ অনুরোধ করবে। কাজ না হলে জলকামান ব্যবহার করবে। এতে না হলে লাঠিপেটা করবে। মারমুখী জনতাকে যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না,
তখন নিজের জীবন ও অস্ত্র রক্ষার প্রয়োজনে গুলি চালাবে। যদি একটি গুলি চালালে পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে, তবে দ্বিতীয় গুলি চালাবে না।

গত শনিবার বাঁশখালীর গন্ডামারায় সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক নিহত হন। আহত হন ৩ পুলিশসহ অন্তত ৩০ জন। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ, পবিত্র রমজান মাসে কর্মঘণ্টা ১০ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টা, শুক্রবার কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৪ ঘণ্টা করাসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজের শ্রমিকেরা।

বাঁশখালী সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে শিল্প গ্রুপ এস আলমের মালিকানায় এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট নামে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। চীনা প্রতিষ্ঠান সেফকো থ্রি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এখানে অর্থায়ন করেছে।

গতকাল রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে নিহতদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। নিহত পাঁচজনের মধ্যে মাহমুদ রেজাই একমাত্র বাঁশখালীর। অপর চারজনের বাড়ি চট্টগ্রামের বাইরে। বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে সবার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে পাঁচজনেরই শরীরে গুলির আঘাতের চিহ্নের কথা লেখা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, খুব কাছ থেকে গুলি করার কারণে নিহতদের শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশ শান্ত রয়েছে উল্লেখ করে বাঁশখালীর ওসি শফিউল কবির গতকাল বলেন, সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। নির্মাণকাজও বন্ধ রয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করছিল। তাঁদের একজন সিলেটের আমিনুল হক। দাবি আদায়ের জন্য তিনিও শনিবার সকালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪ নম্বর গেটে বিক্ষোভ করেন। এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তাঁর পেটে গুলি লাগে।

গতকাল দুপুরে হাসপাতালের শয্যায় আমিনুল হক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার সকাল ১০টার দিকে সবাই দাবি আদায়ের জন্য ৪ নম্বর গেটে দাঁড়ান। তাঁদের চারজন প্রতিনিধি পুলিশসহ মালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে যান। তাঁরা আধা ঘণ্টা পর ফিরে এসে জানান, দাবি মানা হবে না। তখন শ্রমিকেরা সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ২ থেকে ৩ মিনিটের মাথায় পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়তে থাকেন তাঁদের ওপর। চোখের সামনে কয়েকজন শ্রমিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

আমিনুল হক বলেন, তাঁদের ধারণা ছিল, পুলিশ টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করবে কিংবা লাঠিপেটা করবে। কিন্তু এসব কিছু না করেই এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে।

শ্রমিকদের ওপর গুলির ঘটনায় যুক্ত ছিলেন গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। ওই ফাঁড়িতে ১৫ থেকে ১৬ জন সদস্য রয়েছে। বাঁশখালী থানার ওসি শফিউল কবির জানান, তাঁদের থানা-পুলিশের কেউ সেখানে ছিলেন না।

তবে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশকে লক্ষ্য করে শ্রমিকেরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন দিয়ে ধ্বংসের চেষ্টা করেন। কয়েজনের হাতে অস্ত্রও ছিল। সম্পদ রক্ষা ও আত্মরক্ষার্থে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছোড়েন। এর আগে টিয়ার গ্যাস, ২৭০টি রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়।

আহত শ্রমিকেরা কেউ রাবার বুলেটে বিদ্ধ হননি, সরাসরি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এতে ঘটনার সূত্রপাত, পুলিশের ওপর হামলা ও গুলি করা সবই উঠে আসবে। আমি নিজেও তদন্ত করব।’

তবে আহত শ্রমিক ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, তাঁদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। বরং পুলিশের সঙ্গে হেলমেট পরা কিছু বহিরাগত ছিল।

এস আলম গ্রুপের ভূসম্পত্তি বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মোস্তান বিল্লাহ দাবি করেন, স্থানীয় কিছু মানুষের ইন্ধনে শ্রমিকেরা উত্তেজিত হয়ে কর্মরত চীনা নাগরিকদের ওপর হামলার চেষ্টা চালান। তাঁদের অনেকের হাতে অস্ত্র ছিল। বেতন দিতে দেরি হওয়ার অভিযোগটি ভিত্তিহীন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ অসহনশীল আচরণ করেছে। বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর শুরুতেই গুলি না চালিয়ে ধাপে ধাপে এগোনো উচিত ছিল। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। নইলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকবে।

মামলার আসামিও শ্রমিক

সংঘর্ষের ঘটনায় শনিবার রাতে সাড়ে তিন হাজার জনকে আসামি করে বাঁশখালী থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। বাঁশখালী থানার ওসি শফিউল কবির প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধাদানের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় দুই থেকে আড়াই হাজার জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছে। এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্টের পক্ষে চিফ কো-অর্ডিনেটর ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন। এতে ২২ জন শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ১ হাজার ৫০ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া প্রকল্পে ১৫ কোটি টাকা ক্ষতি ও ১০ কোটি টাকার সম্পদ লুটের অভিযোগ আনা হয়। দুই মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে নিহত শ্রমিকদের পরিবারের পক্ষে কোনো মামলা হয়নি।

মামলার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশে থাকা শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দারা। গ্রেপ্তার এড়াতে রাতের বেলা তাঁরা পাহারা বসিয়েছেন। ঘটনায় জড়িত না থাকলেও পুলিশ গ্রেপ্তার করবে—এমন ভয়ে আছেন শ্রমিকেরা। কয়েকজন শ্রমিক বলেন, পুলিশের গুলিতে তাঁদের সহকর্মী মারা গেছেন, উল্টো তাঁরাই আতঙ্কে রয়েছেন।

৫ বছর আগের ৪ খুনের কিনারা হয়নি

২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে স্থানীয় লোকজন বিক্ষোভ মিছিল করলে সেদিন তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। এতে স্থানীয় বাসিন্দা দুই সহোদর মর্তুজা আলী ও আনোয়ারুল ইসলাম, জাকের আলী ও মো. জাকের নিহত হন। এই ঘটনায় উল্টো তিন সহস্রাধিক গ্রামবাসীকে আসামি করে পুলিশ তিনটি মামলা করে। তখনো নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা হয়নি। পরে জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে না পেরে পুলিশ তিন মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।

নিহত মর্তুজা ও আনোয়ারুলের বড় ভাই বদিউল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা পুলিশ শেষ করে দিয়েছে। আমরা গরিব মানুষ, কী করব। তাদের সঙ্গে পারব না। আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।’