Thank you for trying Sticky AMP!!

বাল্যবিবাহ কমছেই না, থামবে কবে?

বাল্যবিয়ে নিয়ে প্রিন্ট সংস্করণে ছাপা হওয়া ইনফোগ্রাফে কিছু ত্রুটি ছিল। এখানে তা সংশোধন করে প্রকৃত ইনফোগ্রাফ দেওয়া হলো।

জাতীয় জরিপ বলছে, তিন বছর ধরে বাল্যবিবাহের হার উঁচুতে আটকে আছে। সরেজমিন অনুসন্ধান বলছে, বাল্যবিবাহ নিরসন ও প্রতিরোধের কার্যক্রমগুলো সামাজিক মনোভাব ও পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার কাছে হার মেনেছে। বিয়েতে অবাধ কারচুপি, কৌশল এবং বিয়ে টিকে থাকাও সমস্যাটি জিইয়ে রাখছে।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, ১৮ বছরের আগেই দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালেও এমনটাই দেখা গিয়েছিল। বাল্যবিবাহের প্রবণতা বুঝতে ২০ থেকে ২৪ বছরের বিবাহিত নারীদের বিয়ের বয়স দেখা হয়েছে। 

তবে বিডিএইচএসের হিসাবে ২০০৭ আর ২০১১ সালেও বাল্যবিবাহের হার ৬৫ শতাংশ বা তার বেশি ছিল। ২০১৪ সালে তা ৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে বটে, কিন্তু সেখানেই থমকে আছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাসটার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০১৯ অবশ্য বাল্যবিবাহের হার কিছুটা কম দেখাচ্ছে। এই নমুনা জরিপ অনুযায়ী, ৫১ শতাংশ মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। ২০১২-১৩ সালে এই হার ছিল ৫২ শতাংশ।

বাল্যবিবাহ ঠেকাতে সরকার নতুন করে আইন করেছে। সরকারি-বেসরকারি অনেক কর্মসূচি আছে। বাল্যবিবাহের প্রতিরোধও কিন্তু বাড়ছে। সরকারের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর ১০টি জেলায় প্রতিরোধের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি। অধিদপ্তর বলছে, জেলাগুলো বাল্যবিবাহের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। 

>বাবা-মায়েরা বিয়ে দিয়ে হাঁপ ছাড়তে চান। মানসিকতা ও পরিস্থিতি প্রতিকূল। মেয়েদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ কম।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক–প্রতিনিধিরা জেলাগুলোতে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখেছে, আইন-কর্মসূচি আর প্রতিরোধ সত্ত্বেও কীভাবে সামাজিক মনোভাব আর পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা জিতে যাচ্ছে। ফেরদৌসী সুলতানা বহু বছর ধরে জেন্ডার সংবেদনশীল জাতীয় নীতি-কর্মসূচি পরিকল্পনার কাজে যুক্ত আছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বেশ কিছু সামাজিক কারণে মেয়েদের নিয়ে অভিভাবকদের মনে বড় স্বপ্ন নেই। পড়াশোনা বন্ধ করলে মেয়েদের জন্য ভালো কাজের সুযোগও নেই। অভিভাবকদের লক্ষ্য মেয়েদের বিয়েতেই আটকে আছে।

বাল্যবিবাহ যেভাবে অদম্য

বাল্যবিবাহ ঠেকাতে সরকার কাজি (বিবাহ নিবন্ধক) ও জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। স্কুল-কলেজে মেয়েদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির একটি উদ্দেশ্য বাল্যবিবাহ কমানো। জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের ১০৯ নম্বরে ফোন করে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে সাহায্য চাওয়া যায়। 

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারের এমন অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসূচি আছে। কর্মসূচি আছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থারও। কিন্তু সামাজিক মনোভাব আর পরিস্থিতির অচলায়তনে ধাক্কা দেওয়া কঠিন হচ্ছে।

গত ডিসেম্বরে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার একটি গ্রামে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক প্রতিবেশী ৯৯৯ নম্বরে কল করে খবরটি জানায়। পুলিশ এসে বিয়ে বন্ধ করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। বাবা মুচলেকা দিয়ে বলেন, ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। কিন্তু পরের দিন নানিবাড়িতে নিয়ে মেয়েটির বিয়ে দেন।

সমাজের প্রবলতর মনোভাব বাল্যবিবাহের পক্ষে। প্রথা ও রীতিনীতির ঝোঁক সেদিকেই। আছে নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো প্রতিকূল পরিবেশের বাধা। শিক্ষা-সচেতনতারও অভাব আছে। 

একাধিক গবেষণা বলছে, ভুয়া জন্মসনদ আর কাজির কারচুপির সাহায্যে অভিভাবকেরা অনায়াসে বিয়ে দিচ্ছেন। ধরা পড়লে কিছু সাজা হচ্ছে কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে তা অবৈধ বা বাতিল হচ্ছে না। টিকে থাকছে। উদ্ভাবনী উপায়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালে একটি বই বেরিয়েছে। বইটি এ দুটি বিষয়কে বাল্যবিবাহ হয়ে চলার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

সরকার কেন এই বাধাগুলো দূর করতে পারছে না? দূর করার জন্য সুনির্দিষ্ট কী করছে? এ বিষয়ে জানতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরাকে বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়েছে। খুদে বার্তাও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, গভীর রাতে এলাকার কোনো মাওলানা বা কাজিকে ডেকে নিবন্ধন ছাড়া অথবা ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ দেখিয়ে নাবালিকার বিয়ে দেওয়া হয়। ভুয়া জন্মসনদ সস্তায় পাওয়া যায়। নোটারি পাবলিকের কাছ থেকে বয়সের ভুয়া হলফনামা করিয়েও বিয়ে হচ্ছে। কখনো কাগজপত্রই থাকছে না। ইদানীং মেয়েকে গোপনে আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে এমন ঘটনার গোনাগাঁথা নেই।

গত ৬ নভেম্বর বাল্যবিবাহ দেওয়ার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাৎক্ষণিকভাবে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কাজি আবদুস সালাম তালুকদারকে ছয় মাসের জন্য জেলে পাঠান। গত ১১ ডিসেম্বর তিনি জামিন পেয়েছেন। তবে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এই কাজি কাগজপত্র ছাড়াই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটির বিয়ে নিবন্ধিত করেছিলেন। কাজি আবদুস সালাম অবশ্য বলেছেন, কাগজপত্র ছিল। পুলিশ আসায় ভয়ে অভিভাবকেরা কাগজপত্র নিয়ে চলে গেছেন। 

বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অঙ্গীকার করেছে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করা তার অংশ। বাল্যবিবাহ নিরোধের জন্য পুরোনো আইনটি ছিল ১৯২৯ সালের। সেটা রদ করে নতুন আইন হয়েছে ২০১৭ সালে। এখানে বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালতের অনুমতি নিয়ে নাবালকের বিয়ের একটি বিশেষ বিধান আছে। 

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক আইনজীবী নীনা গোস্বামী আইনের দুর্বলতা এবং প্রয়োগের শিথিলতাকেও দায়ী করলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নতুন আইনে অভিভাবকের পাশাপাশি পাত্র–পাত্রী, কাজি ও আয়োজনকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে। শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ অনেকটা বেড়েছে। কিন্তু বাল্যবিবাহ বাতিল হচ্ছে না। ফলে শাস্তি কিছু হতে পারে জেনেও অভিভাবকেরা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।

‘মাইয়া ডাঙ্গর’ আর ‘পোলা ভালো’

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ২০১৮ সালে দেশজুড়ে মোট ১ হাজার ৭৫৬টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের তথ্য পেয়েছে। প্রতিরোধ সবচেয়ে বেশি হয়েছে কুমিল্লায়, ঘটনার সংখ্যা ১৮২। ময়মনসিংহে এ সংখ্যা দেড় শতাধিক। সর্বোচ্চ ১০ জেলার মধ্যে আরও আছে গাজীপুর, পাবনা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, খুলনা ও রাজশাহী। 

নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ নামে পরিচিত একটি কর্মসূচি আছে। এর পরিচালক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাল্যবিবাহ গোপনে হয়। তাই এর হিসাব পাওয়া কঠিন। তবে মানুষ সচেতন হয়েছে, প্রতিরোধ বাড়ছে। অভিজ্ঞতায় বলছে, বাল্যবিবাহের ঘটনা বেশি হলে প্রতিরোধও বেশি হয়। তাই কোথাও প্রতিরোধ বেশি হওয়া মানে সেখানে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিও বেশি।

এই প্রতিবেদক ময়মনসিংহের সদর ও গৌরীপুর উপজেলা এবং কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গ্রাম ও চরাঞ্চলে ঘুরেছেন। প্রথম আলোর স্থানীয় সাংবাদিকেরা বাদবাকি আট জেলার বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিনে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝতে চেয়েছেন। দেখা যায়, ‘মেয়ের বিয়ে দিলেই মিটে যায়’, ‘রাস্তায় পোলারা ইভ টিজিং করে’, ‘যদি মাইয়ার লাইন হয়?’, ‘মাইয়া ডাঙ্গর হইছে’, ‘পোলা বিদেশ থাকে’, ‘পোলা ভালো চাকরি করে’—এই বক্তব্যগুলোর মধ্যেই ঘুরপাক খায় বাল্যবিবাহের কারণ। 

কুমিল্লার দাউদকান্দিতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মিলিয়ে অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়, সেখানে বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ উত্ত্যক্তকরণ। কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ নেন না। খুলনা ও ঝিনাইদহে বাবা-মারা বলেছেন, স্থানীয় যুবকদের উৎপাত ও আধিপত্যের কারণে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন। 

মেয়ের প্রেম করার সম্ভাবনাকেও অভিভাবকেরা নিরাপত্তাহীনতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। স্কুল দূরে, রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, মেয়ে বড় হয়েছে বলে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন ফিসফাস করছেন, অভাবের সংসার—সমস্যা যা-ই হোক, অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ের মধ্যেই সমাধান খোঁজেন।

কিছু এলাকায় দরিদ্র পরিবারে অষ্টম শ্রেণি পাসকেই মেয়েদের জন্য সর্বোচ্চ শিক্ষা মনে করা হয়। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার খোদাবক্সপুর গ্রামের মণ্ডলবাড়িতে ১৫টি পরিবারের বসবাস। বাড়ির ছেলেরা উচ্চমাধ্যমিক বা স্নাতকে পড়াশোনা করছে। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করা কোনো মেয়ে নেই। 

সদর উপজেলার ভাবখালী গ্রামের এক কৃষক বাবার ছেলে স্নাতক পর্যায়ে পড়ছেন। কিন্তু তিন মেয়েকে তিনি প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়ার পরপরই বিয়ে দিয়েছেন। আরেক মেয়ে সপ্তম শ্রেণি পাস করেছে, তার বিয়ের চেষ্টা করছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাইয়াগো বেশি দূর লেহাপড়া করাইয়া লাভ কী? বিয়ার পর তো ঘরের কামই করতে হবে। পোলারা না পড়লে চাকরিবাকরি কেমনে করবে?’

জামালপুরের মহিষবাথান আর এম উচ্চবিদ্যালয় থেকে গত বছর এসএসসি পাস করেছে আফরা ইবনাত। আফরা বলে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে তার ক্লাসে ১১৬ জন ছাত্রী ছিল। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ৮৬ জন। বাকিরা বিয়ে হয়ে স্কুল ছেড়েছে। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও পাঁচজন ছিল বিবাহিত। শিক্ষক জিয়াউল হক বলেন, পরীক্ষার পরে কমবেশি ৩০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।

ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও রাজশাহীতে দেখা গেছে, বিয়ে দেওয়ার প্রথম হিড়িক পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর। অষ্টম শ্রেণিতে উঠলে আরেক দফা এবং দশম শ্রেণিতে ওঠার পর আবার বিয়ের ঝোঁক পড়ে। একেক এলাকায় ভালো পাত্রের গুণ বিবেচনা একেক মাপকাঠিতে। কিন্তু ‘ভালো পাত্র’ পেলে মেয়েকে বিদায় করার ঝোঁক সবখানেই এক রকম। 

ময়মনসিংহে শিক্ষার হার কম, দারিদ্র্যের হার উঁচু। এখানে ভালো পাত্র হচ্ছে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর চাকরিজীবীরা। এমন পাত্র পেলে মোটা যৌতুক দিয়েও মেয়ের বিয়ে দেন অভিভাবকেরা। কুমিল্লায় মেয়ের মা–বাবা প্রবাসী ছেলেকে হাতছাড়া করতে নারাজ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ ২০১৭ সালে বাল্যবিবাহের পটভূমি এবং প্রভাবের ওপর একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সমীক্ষাটি বাল্যবিবাহের কারণের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বাল্যবিবাহের হারের সম্পর্ক পেয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলাজুড়ে রয়েছে যমুনাসহ ছোট-বড় ১০টি নদ-নদী। এ কে এম সফিকুল ইসলাম জেলায় শিশুদের জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার একটি প্রকল্পের সমন্বয়ক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নদীভাঙন, বন্যা আর যাতায়াত-যোগাযোগের সমস্যার কারণে সেখানে বাল্যবিবাহ বেশি। রাজশাহী আর ময়মনসিংহের চরাঞ্চলেও বাল্যবিবাহের ঘটনা বেশি।

প্রতিরোধ, প্রতিকার

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, কম বয়সী প্রতিবেশীরাই মূলত এমন ঘটনার কথা প্রশাসনকে জানায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ নিয়ে কদাচিৎ গলা তোলেন। বরং অনেক সময় তাঁরা বাল্যবিবাহে নেতৃত্ব দেন। কখনো এমনকি বাল্যবিবাহ ঠেকাতে গেলে জনপ্রতিনিধিরা বাধা দেন। 

গত ৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে একটি বাল্যবিবাহের আগাম খবর আসে। বিয়েটি বন্ধ করার জন্য এলাকায় যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য উল্টো খারাপ ব্যবহার করেন।

ময়মনসিংহ মহিলা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম অফিসার শারমিন শাহাজাদী বলেন, জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ বাল্যবিবাহে সহায়তা করেন। ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরিতেও সহায়তা করেন। আর হালুয়াঘাটের ইউএনও মো. রেজাউল করিম বলেন, জনপ্রতিনিধিরা নিজে থেকে কখনো বাল্যবিবাহের কথা জানান না। তবে তাঁদের বললে তাঁরা বিয়ে বন্ধ করতে উদ্যোগী হন।

ফরিদা ইয়াসমীন ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। নেত্রকোনার বারহাট্টার ইউএনও থাকার সময় পৌনে দুই বছরে তিনি ৫৯টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন। তিনি এ বছর ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর মতে, বাল্যবিবাহের মূল কারণ মেয়েকে সম্পদ মনে না করা। প্রতিকারের মূল উপায়, দারিদ্র্য দূর করা।

বাল্যবিবাহ নিরোধের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) নিয়েছে। লক্ষ্য হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিয়ে পুরো বন্ধ করা এবং সার্বিক বাল্যবিবাহের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা। চূড়ান্ত লক্ষ্য, ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করা।

জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানার মতে, আইন আর দণ্ডের স্লোগান থেকে বের হওয়ার সময় হয়েছে। বরং মেয়েরা লেখাপড়া করলে কী করতে পারবে, পরিবার কী সুবিধা পাবে—এসব কথা সবাইকে বলতে হবে। পাশাপাশি সব পর্যায়ে মেয়েদের জন্য দক্ষতা বাড়ানো এবং কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন গাজীপুর, পাবনা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, খুলনা ও রাজশাহী প্রতিনিধি ও প্রতিবেদকেরা