Thank you for trying Sticky AMP!!

বাসা ভাড়া নিয়ে কিশোরীকে ভুলিয়ে পাচার করতে চেয়েছিল চক্রটি

প্রতীকী ছবি

মেয়েটির বয়স মাত্র ১৩। বাবা মারা গেছেন। মায়ের সঙ্গে রাজধানীর সবুজবাগে নিজেদের বাড়িতে থাকত। সবুজবাগেরই একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত মেয়েটি। বছর দেড়েক আগে জান্নাতুল জেরিন ও প্রতীক খন্দকার নামে এক দম্পতি তাঁদের বাসা ভাড়া নেন। স্কুলছাত্রী ও তার মায়ের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলে ওই দম্পতি। পরে ওই কিশোরীকে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বেনাপোল সীমান্তে। যশোরের শার্শার সীমান্তবর্তী এলাকার একটি বাসায় তিন দিন আটকে রাখা হয় এবং সেখানে ওই কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। অবশ্য খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশ কিশোরীকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠায়।

২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর পাচারের উদ্দেশ্যে কিশোরীকে বেনাপোল সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়। এ ঘটনার তদন্ত করে গিয়ে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। সিআইডির তদন্তে উঠে আসে, এই মানব পাচারকারী চক্রটি এর আগেও একাধিক নারীকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করেছে। ভারতে পাচার হওয়া এক নারীর জবানবন্দিও রেকর্ড করেছে সিআইডি।

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতকে সিআইডি এক প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, ওই কিশোরীকে ভারতে পাচারের চেষ্টা এবং ধর্ষণের সঙ্গে একাধিক পাচারকারী জড়িত। ঘটনাটি একটি আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধ। বাংলাদেশসহ ভারতেও সংঘবদ্ধ পাচারকারী রয়েছে। আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘবদ্ধ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য কলকাতা পুলিশের কাছে আবেদন করা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সবুজবাগের সপ্তম শ্রেণির ওই ছাত্রীকে ঢাকা থেকে বেনাপোলে নিয়ে ভারতে পাচারের চেষ্টা চালায় মানব পাচারকারীরা। সেখানে ওই কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত মানব পাচারকারী চক্রের ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চক্রটি অনেক নারীকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করেছে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়ার পর খুব শিগগির আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া এক কিশোরী মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনাটি মর্মান্তিক। ওই কিশোরীর মতো আরও অনেক নারী নানাভাবে ভারতে পাচার হচ্ছেন। তাঁরা দুর্বিষহ জীবনের মুখোমুখি হচ্ছেন। মানব পাচারের ঘটনা রোধে ব্যক্তি ও পরিবারের সচেতনতা খুব প্রয়োজন। আর এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত মানব পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

কিশোরীকে অজ্ঞান করা হয়

ভুক্তভোগী কিশোরীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এবং মামলার নথিপত্র বলছে, স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশে সেদিন ঘর থেকে বের হয় ওই শিক্ষার্থী। সন্ধ্যা হলেও ফিরে না আসায় কিশোরীর মাসহ আত্মীয়স্বজন বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। কোথাও খুঁজে না পেয়ে পরে পুলিশের সহযোগিতা চান তাঁরা। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় কিশোরীকে যশোরের শার্শা এলাকার একটি বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

কীভাবে অপহরণের শিকার হয়েছিল, সে ব্যাপারে ভুক্তভোগী কিশোরী প্রথম আলোকে বলে, স্কুলের ফটক থেকে তাদের এলাকারই একজন তাকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তোলেন। এরপর কৌশলে তার শরীরে ইনজেকশন পুশ করেন। অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে। যশোরে গিয়ে তার জ্ঞান ফেরে। তখন চালকের সহকারী (হেলপার) ‘বেনাপোল, বেনাপোল’ বলে চিৎকার করছিল। তখন বাসের ভেতর সে আরেক কিশোরীকে দেখতে পায়। সে তার পূর্বপরিচিত ছিল।

ভুক্তভোগী কিশোরীর মা প্রথম আলোকে বলেন, যে কিশোরী তার মেয়েকে পাচার করার উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে বেনাপোল নিয়ে গিয়েছিল, সে তাদের বাসার ভাড়াটে জেরিনদের গৃহকর্মী ছিল। জেরিন, তাঁর স্বামী প্রতীক এবং তাঁদের গৃহকর্মী মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য। এমনকি যে ব্যক্তি স্কুলের ফটক থেকে কিশোরীকে তুলে নিয়েছিলেন, তিনিও ওই একই চক্রের সদস্য বলে অভিযোগ করেন কিশোরীর মা। পুলিশি তৎপরতার কারণে তাঁর মেয়েকে মানব পাচারকারীরা ভারতে পাচার করতে পারেনি। তবে তাঁর মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। ওই ঘটনার পর থেকে তাঁর মেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রতিবেদনেও উঠে আসে, সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়। সিআইডি বলছে, সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য আক্তারুল (৪০) ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে। ভুক্তভোগী কিশোরী ঢাকার আদালতে জবানবন্দি দেয়।

ভুক্তভোগী এক নারীর জবানবন্দি

তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এবং মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ১৩ বছর বয়সী কিশোরীকে যারা ভারতে পাচারের চেষ্টা চালিয়েছিল, সেই একই মানব পাচারকারী চক্র ২৬ বছর বয়সী এক নারীকে ভারতে পাচার করে। অবশ্য ওই নারী গত বছর ভারত থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। গত বছরের ২৪ আগস্ট ওই নারী ঢাকার সিএমএম আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন।

সিআইডি কর্মকর্তা জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যে চক্রটি কিশোরীকে ভারতে পাচার করার চেষ্টা করেছিল, সেই একই চক্র এর আগে ২৬ বছরের নারীকে ভারতে পাচার করে দিয়েছিল। সেই নারী সবিস্তার আদালতকে জানিয়েছেন, তিনি কীভাবে পাচারের শিকার হন। মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে তিনি বেনাপোল সীমান্তবর্তী এলাকায় যান। মানব পাচারে জড়িত যশোরের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেন। ওই এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, বেনাপোল সীমান্তবর্তী এলাকায় সংঘবব্ধ মানব পাচার চক্রের শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা বহু নারীকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করেছে।

মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার কিশোরীকে ভারতে পাচারের চেষ্টার ঘটনায় জড়িত মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য যশোরের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন রফিকুল ইসলাম (৩৫), বিপ্লব ঘোষ (৩৭), আক্তারুল ওরফে আক্তার হোসেন (৪০), বাবুল হোসেন (৩৫) ও শাহীন আলম (৩৫)। এ ছাড়া ঢাকায় বসবাসকারী মহেমুনুজ্জামান ওরফে প্রতীক খন্দকার (২৬) ও তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ওরফে জেরিন (২৫), সৈয়দ রিফাত হোসেন (২৮) ও তাঁর মা জাকিয়া আক্তারকে (৫২) এবং এক কিশোরীকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।