Thank you for trying Sticky AMP!!

মধ্যপ্রাচ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি মেয়েরা

সংসারে সচ্ছলতার আশায় কুড়িগ্রামের এক নারী মাস ছয়েক আগে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যান। কিন্তু সৌদি গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। পরে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেন রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে। দুই মাস পর ৬ এপ্রিল দেশে ফিরেছেন।
গতকাল প্রথম আলোকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন এই নারী। তাঁর স্বামী ও ভাই কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবই তো শুনছেন। এখন আমরা কী করব বলে দেন।’
সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে গত এক বছরে এমন দেড় শতাধিক নারী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এবং নির্যাতিত ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা এসব তথ্য দিয়েছেন।
নির্যাতিত ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জীবন বাঁচাতে ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও নির্যাতন সামলাতে না পেরে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে দূতাবাসের সেফ হাউসে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ১৫০ জন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। গত তিন মাসেই ৩৫ নারীর স্বজনেরা তাঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য আবেদন করেছেন।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, লেবানন, ওমান ও কাতারেও গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারীরা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এক বছরে আড়াই শরও বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এসব দেশে। এর মধ্যে সৌদি আরবের ৬০ জন, লেবাননের ৪৩ জন, জর্ডানের ৪৪ জন, দুবাইয়ের ৩৩ জন, আবুধাবির ১০ জন, ওমানের ১৪ জন ও কাতারের ১০ জনের স্বজনেরা তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে চিঠি দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১০০ জনেরও বেশি দেশে ফিরেছেন।
এ ছাড়া সিরিয়ায় অবৈধভাবে পাচার হওয়া বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নারী যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ পরিবারের উদ্যোগে দেশে ফিরতে পেরেছেন। এ নিয়ে তাঁদের পরিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর চুক্তি হয়। সে বছর ২০ হাজার ৯৫২ জন নারী দেশটিতে গিয়েছেন। আর এ বছরের প্রথম তিন মাসেই গেছেন ২০ হাজার ৩৬ জন। এ ছাড়া গত তিন বছরে ৬০ হাজার নারীকর্মী জর্ডানে, ৫০ হাজার নারী আরব আমিরাতে, ৪০ হাজার নারী লেবানন, ৩০ হাজার নারী ওমান ও ১৭ হাজার নারী কাতারে গেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী নির্যাতন নতুন কিছু নয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা অনেক দিন ধরেই বিষয়টি তুলে ধরছে। নির্যাতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ দুই-তিন বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মী পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে গত বছর থেকে নারী কর্মীরা যাচ্ছেন। আর সেখানেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের অভিযোগ। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানোর যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে সেটি হচ্ছে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাগুলো দুঃখজনক। আমরা যখনই এই ধরনের অভিযোগ পাই, তাঁদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করি। অন্তত ১০০ মেয়েকে আমরা ফিরিয়ে এনেছি। সচিবের নেতৃত্বে আমাদের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সৌদি আরব ঘুরে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে এসেছে। যেসব গৃহকর্তা এসব ঘটাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ওই দেশের আইনে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটিও আমরা দেখছি।’
নির্যাতন, গায়ে আগুন, মাথায় সেলাই: সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা রংপুরের এক নারী বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারে অভাবের কারণে তিনি ২০১৫ সালের ২৫ জুন সৌদি আরবে যান। যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেখানে তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। বাইরে থেকে আসা পুরুষেরাও নির্যাতন করত। প্রতিবাদ করায় গত বছরের ২১ আগস্ট তাঁর গায়ে আগুন দেওয়া হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেয়েটি বলেন, ‘আর কোনো মেয়েকে যেন ওই দেশে পাঠানো না হয়।’
এই বছরের ২ জানুয়ারি সৌদি আরবে যান ঢাকার উত্তর বাড্ডার এক নারী। যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, ওই বাসার পুরুষেরা তাঁকে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করত। প্রতিবাদ করলে তাঁর চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হতো। মেয়েটির ভাই জানান, তিনি মন্ত্রণালয়ে অবেদন করার পর দুই মাসেও বোনকে ফেরত আনা হয়নি।
মানিকগঞ্জের পূর্ব আওরাঙ্গবাদ গ্রামের এক নারী সৌদি আরবের বনি ইয়াসার এলাকায় কাজ করতেন। নির্যাতনের কারণে গত ১৭ মার্চ চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে এখন তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে। গত বছরের ১১ নভেম্বর সৌদি আরবে যান কুমিল্লার এক নারী। তাঁকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দিলে ১৪টি সেলাই লাগে।
ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন: সৌদি আরব থেকে ফেরা তিনজন নারী যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। যশোরের এক নারী বলেন, গত বছরের ৫ নভেম্বর তাঁকে সৌদি আরবে পাঠায় ফাতেমা ওভারসিজ। যে বাসায় কাজ করতেন, সেই বাসার গৃহকর্তা, তাঁর ছেলে এবং ছেলের বন্ধুরা তাঁকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করেছে। ঢাকার শাহবাগ এলাকার এক লোক অভিযোগ করেছেন, তাঁর স্ত্রীকে সৌদি আরবে একটি কক্ষে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। কেরানীগঞ্জের এক নারীর স্বামী অভিযোগ করেছেন, তাঁর স্ত্রীকে যৌনকাজের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। কুমিল্লার একজন জানান, তাঁর স্ত্রী নির্যাতন সইতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে সৌদি নিয়োগকর্তার কাছে যান। কিন্তু নিয়োগকর্তা তাঁকে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন না।
সৌদি দূতাবাসের বিভিন্ন চিঠিতেও এই চিত্র উঠে এসেছে। গত ৪ নভেম্বর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে সৌদি রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ লেখেন, ‘এ পর্যন্ত ৫৫ জন গৃহকর্মী অতিরিক্ত কাজের চাপ, দুর্ব্যবহার বা নির্যাতনের কারণে গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিদিনই তিন-চারজন গৃহকর্মী এভাবে আশ্রয় নিচ্ছে।’ গত অক্টোবরে পাঠানো আরেক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘গৃহকর্মীদের মধ্যে ৫৬ জন দূতাবাসের সহায়তায় এবং ৫৫ জনকে রিয়াদের দুটি কোম্পানির সহায়তায় দেশে পাঠানো হয়েছে। যাঁরা আসছেন, তাঁদের অনেকেরই শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নেই। সৌদি গৃহকর্তাদের বিরুদ্ধেও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।’ ওই চিঠিতে নারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনে আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ বেশ কটি বিকল্প প্রস্তাব দেন তিনি।
বাংলাদেশি অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যাঁরা গৃহকর্মী হিসেবে যাচ্ছেন, প্রতিদিনই তাঁদের কারও না কারও নির্যাতনের খবর পাচ্ছি। এটি বন্ধ করতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। পাঠানোর আগে প্রত্যেককে মোবাইল ফোন দেওয়া ও দূতাবাসের পক্ষ থেকেও নিয়মিত তদারকির জন্য বহুদিন ধরে বলছি।’
অভিযোগ আছে, জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো একেকজনকে পাঠানোর জন্য এক হাজারের বেশি ডলার পায় বলে তারা যেকোনোভাবে নারী কর্মী পাঠাতে মরিয়া থাকে। তবে বায়রার সভাপতি আবুল বাসার বলেন, ‘সৌদি আরবের নিয়োগকর্তারা আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছিল, আমাদের মেয়েরা কোনোভাবেই নির্যাতিত হবে না। কোনো ঘটনা ঘটলে উভয় পক্ষই তদন্ত করবে। যখনই কোনো অভিযোগ উঠছে, যে প্রতিষ্ঠান তাকে পাঠাচ্ছে তারা উদ্যোগী হয়ে ফেরত আনছে।’
অন্য দেশেও নির্যাতন: খুলনার দৌলতপুরের এক নারী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বোন গত বছর জর্ডানে যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেখানে তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। গৃহকর্তা তাঁর বোনের সারা শরীরে মদ ঢেলে দিতেন। তিনি বোনকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে চিঠি দিলেও এখনো আনতে পারেননি।
জর্ডান, লেবানন, ওমান, কাতার, দুবাই ও আবুধাবিতে এমন শতাধিক নির্যাতনের অভিযোগ প্রথম আলোর কাছে রয়েছে। ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ৬ মার্চ সরকারকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ ওমানে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী আসছে, যাদের অনেকেই নির্যাতনের শিকার। অনেকে পতিতাবৃত্তিতে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। এসব কারণে ভবিষ্যতে দূতাবাসের ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে পারে।’