Thank you for trying Sticky AMP!!

লোকটি মরে যাচ্ছিল, আর বাসটি ছুটছিল

রেজাউল করিম নিহত হওয়ার খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা মনোয়ারা বেগম। শোকস্তব্ধ অন্য স্বজনেরা। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের সিটি গেট এলাকার কালিরহাটের বাড়িতে। ছবি: জুয়েল শীল
>
  • ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিটি গেট এলাকার কাছে ঘটনা
  • নিহত যাত্রীর নাম রেজাউল করিম
  • বাড়ির কাছে রেজাউলকে বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়
  • হেলপারের সঙ্গে ঝগড়ার পর রেজাউলকে ধাক্কা মারা হয়
  • চালককে ধাওয়া করেও ধরতে পারেননি যাত্রীরা

‘আমি পেছনের আসনে ছিলাম। কী নিয়ে জানি হেলপারের সঙ্গে একজনের ঝগড়া হচ্ছিল। গ্ল্যাক্সোর সামনে আসার পর কয়েকজন যাত্রী চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বলেন। তাঁরা বলেন, লোকটি মরে গেল তো! গাড়ি থামান। কিন্তু বাসটি দুরন্তগতিতে ছুটছিল। একটু পর গাড়ি থামিয়ে পালিয়ে যান চালক ও সহকারী। ততক্ষণে সব শেষ।’ চট্টগ্রাম শহরে এক যাত্রীকে চলন্ত বাস থেকে ফেলে হত্যার ঘটনার এমন বর্ণনা দেন সাইফুল ইসলাম নামের আরেক যাত্রী।

নিহত যাত্রীর নাম রেজাউল করিম (৩৫)। নগরের সিটি গেট এলাকার কালিরহাটের বাসিন্দা মো. ওয়ালি উল্লাহর ছেলে তিনি। বাড়ির কাছে এসে তাঁকে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ তাঁর স্বজনদেরও।

প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রী সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘চালককে ধরতে আমরা কয়েকজন পেছন পেছন ছুটেছি। কিন্তু ধরতে পারিনি।’

জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিটি গেট এলাকার কাছে গ্ল্যাক্সো কার্যালয়ের সামনে গতকাল সোমবার বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকে ঘটনাটি ঘটে। বাসে হেলপারের সঙ্গে ঝগড়ার বিষয়টি ফেলে দেওয়ার ৫ মিনিট আগে মুঠোফোনে জিল্লুর রহমান নামে এক প্রতিবেশীকে জানিয়েছিলেন রেজাউল।

ধাক্কা দেওয়ার পর যাত্রীদের চাপে কিছু দূর গিয়ে রাস্তায় বাসটি রেখে পালিয়ে যান চালক ও সহকারী। এ ঘটনার প্রতিবাদে সিটি গেট এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা প্রায় দেড় ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে।

শহর এলাকার এই বাসগুলো সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী থেকে নগরের জিইসি পর্যন্ত চলাচল করে। বেশির ভাগ বাসের মধ্যে কোনো পরিবহনের নাম লেখা থাকে না। শুধু ৪ নম্বর লেখা থাকে। তবে এই বাসটির গায়ে লুসাই পরিবহন লিমিটেড লেখা ছিল। নম্বর হচ্ছে চট্ট মেট্রো-জ-১১-১৮০৩।

এর আগে গত ২২ জুলাই চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার এলাকায় বেকারি কর্মী আমানউল্লাহর ওপর দিয়ে ট্রাক তুলে দেন চালক। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান আমানউল্লাহ। ট্রাক ধাক্কা দেওয়ার উপক্রম করলে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। এই ছিল তাঁর দোষ। এ ঘটনায় তাঁর বাবা জাকের হোসেন বাদী হয়ে নগরের চান্দগাঁও থানায় মামলা করেন। গ্রেপ্তার হওয়া চালক একরাম খান পরে জামিনে মুক্তি পান।

আগের দিন ২১ জুলাই ঢাকায় যাওয়ার পথে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েলকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া এলাকায় বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁর বাড়িও চট্টগ্রামের হালিশহরে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের পরও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। উল্টো পরিবহনশ্রমিকদের দাপট চলছে দেশজুড়ে।

রেজাউল করিম

গতকালের ঘটনা যেভাবে
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেজাউল সকালে সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া যান। সেখান থেকে ফিরতি পথে ভাটিয়ারী নামেন। ৪ নম্বর বাসযোগে ভাটিয়ারী এলাকা থেকে সিটি গেট এলাকায় ফিরছিলেন তিনি। বেলা ১টা ৩৫ মিনিটে তিনি এলাকার বড় ভাই জিল্লুর রহমানকে ফোন করে বলেন, বাসে তাঁর সঙ্গে পরিবহনশ্রমিকের ঝামেলা হচ্ছে। গ্ল্যাক্সো কার্যালয়ের পাশের বাসস্ট্যান্ডে তিনি যেন একটু থাকেন। এর ৫ মিনিট পর থেকে জিল্লুর ফিরতি ফোনে আর রেজাউলকে পাচ্ছিলেন না।

সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শামসুল হুদা বেলা ১টা ৪২ মিনিটে জিল্লুরের ফোন ধরে বললেন, রেজাউলের অবস্থা খারাপ। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। বেলা দুইটার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চিকিৎসক রেজাউলকে মৃত ঘোষণা করেন।

জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে ফোন দেওয়ার পর আমি বাসস্ট্যান্ডে যাই। কিন্তু এরপর আর রেজাউলকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। কোনো বাসও থামেনি। এর আগে তার সঙ্গে বাসে ঝামেলা হচ্ছে বলে জানায়।’

ইউপি সদস্য শামসুল হুদা বলেন, ‘১টা ৪০ মিনিটের দিকে দেখি রাস্তায় একটি লোক কাতরাচ্ছে। কেউ তাকে তুলছে না। পরে আমি তুলতে গিয়ে দেখি রেজাউল। এর মধ্যে জিল্লুর ফোন করেন রেজাউলের নম্বরে। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ঝগড়ার একপর্যায়ে রেজাউলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়।’

জানা গেছে, রেজাউলকে ফেলে দেওয়ার পর বাসের যাত্রীরা বারবার গাড়ি থামাতে বলেন। কিন্তু চালক বাস টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রায় ১০০ মিটার যাওয়ার পর সিটি গেটের কাছে বাস থামিয়ে চালক ও সহকারী পালিয়ে যান। কয়েকজন যাত্রী এবং স্থানীয় লোকজন ধাওয়া করেও তাঁদের ধরতে পারেননি।

বাস থেকে ফেলে রেজাউল করিমকে হত্যার প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করেন এলাকাবাসী। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের সিটি গেট এলাকার কালিরহাটে। প্রথম আলো

সড়ক অবরোধ
স্থানীয় লোকজন সড়কে অবরোধ করে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। পাশাপাশি অবিলম্বে গাড়ির লোকজনকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির দাবি জানাতে থাকে। পুলিশ তাদের বুঝিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা পর সড়ক থেকে তুলে দেয়।

আকবর শাহ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) উৎপল বড়ুয়া জানান, ‘যে বাসের যাত্রী ছিল সেই বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে রেজাউল মারা যায় বলে শুনেছি। এর প্রতিবাদে স্থানীয় লোকজন আধঘণ্টার মতো সড়ক অবরোধ করেছে। গাড়িচালককে খোঁজা হচ্ছে।’

থানার ওসি জসীম উদ্দিন বলেন, ‘শুনেছি রেজাউলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। চালককে ধরতে পারলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’

রেজাউলরা এক ভাই, দুই বোন। বাবা-মা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তবে ঈদ করার জন্য দেশে এসেছেন। রেজাউল পাঁচ বছর আগে দুবাই থেকে দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেন। গতকাল বিকেলে রেজাউলদের কালিরহাটের বাসায় দেখা যায়, তাঁর বাবা, মা ও স্ত্রী কাঁদছেন। রেজাউলের দেড় বছরের একমাত্র মেয়ে সাবা ওয়ালিয়া করিম। সবাইকে কাঁদতে দেখে সে-ও কাঁদতে শুরু করে।