Thank you for trying Sticky AMP!!

সৌদিতে গেলেন আশা নিয়ে, ফিরলেন নির্যাতন ভোগ করে

সৌদি আরবে অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দেশে স্বজনদের কাছে অনেক টাকা পাঠাবেন। সংসারে সচ্ছলতা ফিরবে। আসবে সুদিন। বাস্তবে সে গুড়ে বালি। মাত্র এক মাসের মধ্যে একবুক যন্ত্রণা, কষ্ট আর বঞ্চনা নিয়ে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। এই নারী বর্ণনা করেছেন সৌদিতে বন্দিদশায় থাকা অবস্থায় ভোগ করা নারকীয় নির্যাতনের কাহিনি।

গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের সখীপুরের ওই নারী। ধরা যাক, তাঁর ছদ্মনাম মারিয়া আক্তার (৪৫)। গত বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায় ওই নারী ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেলা তিনটার দিকে সখীপুর পৌরসভার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন।

মারিয়া আক্তারের বাড়ি উপজেলার একটি গ্রামে। গত ২৫ এপ্রিল তিনি ২০ হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব গিয়ে একটি চক্রের খপ্পরে পড়েন। সেখানে একটি ঘরে আটক রেখে তাঁকে নির্যাতন করা হয়।

ওই নারী গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরবে আটক থাকা আরও ৪০ থেকে ৪৫ জন নারীকে বাঁচান ও তাঁদের মুক্ত করে আনুন। বন্দিশালায় ওরা শুধু একবেলা লবণ মেশানো আধা থালা ভাত দিত। এই খেয়ে আমরা সবাই কোনোমতে দিন কাটাতাম।’

মারিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার বাবা গরিব। ১৬ বছর আগে আমাকে প্রায় ৬০ বছরের এক বৃদ্ধের কাছে বিয়ে দেন। ওই সংসারে দুই মেয়ের জন্ম হয়। বর্তমানে একজন দশম শ্রেণিতে, অপরজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। স্বামীর বয়স ৭৫ বছর হওয়ায় সংসারের কোনো কাজই করতে পারেন না। ফলে সব দায়িত্ব পড়ে আমার ঘাড়ে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য সাইফুল ইসলাম একদিন আমার কাছে আসেন। তিনি বলেন, মাত্র ৬৫ হাজার টাকা হলে বিদেশ যাওয়া যাবে। এখন দিতে হবে মাত্র ৩৫ হাজার। বাকি টাকা বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে। সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে গিয়ে দুজন বৃদ্ধের দেখাশোনা করতে হবে। বেতন দেওয়া হবে মাসে ২০ হাজার টাকা।’

ওই নারী বলেন, ‘তাঁর এমন শর্তে শেষ পর্যন্ত আমি এপ্রিলের ২৫ তারিখে সৌদি আরবে যাই। প্রথম দুই দিন একটা ঘরে থাকি। তৃতীয় দিন আমাকে একটি গাড়িতে করে এক ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভবনের ওই কক্ষে আমার সঙ্গে আরও ৪০ থেকে ৪৫ জন নারীকে রাখা হয়। আগে থেকে রাখা ওই নারীদের কাছ থেকে শুনতে পারি নানা নির্যাতনের কথা।’

মারিয়ার ভাষ্য, সেখানে অন্তত ১০ নারী তাঁকে বলেন, অনৈতিক কাজ না করলে শরীরে গরম পানি ঢালাসহ মারধর করা হয়। গরম রড দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। সৌদিফেরত মারিয়া বলেন, ‘কয়েকজন নারীকে আমি ওখানে ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় দেখেছি। আমি ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে থাকি। এর মধ্যে সাত-আট দিন পর ফিলিপাইনের এক নারীর মাধ্যমে বাংলাদেশে আমার মেয়ের কাছে এসব নির্যাতনের কথা জানাই। ১০-১২ দিন পর একদিন আমার ডাক পড়ে। আমাকে একটি গাড়িতে করে একটি কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে আনুমানিক ৪০ বছরের এক সৌদি নাগরিকের হাতে-পায়ে ধরি, কান্নাকাটি করি। আমার আকুতি-মিনতি দেখে তিনি আমার পেটের মধ্যে একটা লাথি মারেন। ওই লোকটি আমাকে যৌন নির্যাতন না করে আবার আগের জায়গায় পাঠিয়ে দেন। এরপর যত দিন থেকেছি, শুধু লবণ মেশানো হাফ প্লেট ভাত খেয়ে থেকেছি। আমার আসার সময় কমপক্ষে ১০-১২ জন নির্যাতিত নারী আমার কাছে আবেদন জানান। দেশে গিয়ে তাঁদের যেন মুক্ত করে নিয়ে যাই।’

মারিয়া যে আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন, গতকাল সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মারিয়া ঘরের মেঝেতে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। প্রচণ্ড জ্বরে শরীর কাঁপছে তাঁর। বড় মেয়ে মাথায় পানি ঢালছে। ওই বাড়ির একজন নারী বলেন, মানসম্মানের ভয়ে মারিয়া আসল কথা খুলে বলছেন না। অনেক কথা চেপে রাখছেন। তিনি শুনেছেন, মারিয়া গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

ওই নারীর বড় মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী বলে, ‘আমার মায়ের ও অন্য নারীদের নির্যাতনের কথা শুনে আমি পাগল হয়ে যাই। দালাল ওই সাইফুলের বাড়িতে গিয়ে মায়ের ফোনের বিষয়ে তাঁকে বিস্তারিত জানাই এবং আমার মাকে ওই বন্দিশালা থেকে মুক্ত করতে আকুতি জানাই। পরে সাইফুলের সঙ্গে ঢাকা শহরের ৪০/১ নয়াপল্টনের এ আর খান ট্রেড সেন্টারের বিএ অ্যাসোসিয়েট নামের ট্রাভেল এজেন্সিতে গিয়ে আমার মাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। ওই অ্যাসিয়েটের মালিক হাজি আহমেদ আনসারী আমার মাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন।’

সাবেক ইউপি সদস্য ও আদম ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চাপে বিএ অ্যাসোসিয়েট ওই নারীকে ওই দেশ থেকে ফিরিয়ে আনে।’ সাইফুল দাবি করেন, ওই নারী যেসব কথা বলছেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। ওই নারী ওই দেশে গিয়ে ভয় পেয়েছেন, পরে নিজের ইচ্ছেতেই দেশে ফিরে এসেছেন।

ঢাকার নয়াপল্টনের ওই বিএ অ্যাসোসিয়েটের একটি ভিজিটিং কার্ডের একটি নম্বরে ফোন করলে আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ওই নারীকে (মারিয়া আক্তার) আমরাই টাকা-পয়সা খরচ করে দেশে ফিরিয়ে এনেছি। দেশে ফিরে ওই নারী যা বলছেন, তা ডাহা মিথ্যা।’

সৌদিফেরত মারিয়া আক্তারের বোন বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা আমার বোন বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।’

সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম তুহীন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ওই নির্যাতিত পরিবারের পক্ষে কেউ মামলা করলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।