Thank you for trying Sticky AMP!!

স্বামীর ঘরেই বেশি মানসিক নির্যাতন

নারীর ওপর সহিংসতা বা নির্যাতনের বিষয়টি নানাভাবে আলোচনায় এলেও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি অনেকটাই আড়ালে থেকে যায়। মানসিক নির্যাতনের বিষয়ে যে আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তা-ও বেশির ভাগ ভুক্তভোগী নারীর অজানা। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের নারীদের ওপর মানসিক নির্যাতনের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটছে তাঁর স্বামীর ঘরে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে করা ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ শীর্ষক জরিপ অনুযায়ী, বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো-না-কোনো সময়ে, কোনো-না-কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮২ শতাংশই মানসিক নির্যাতনের শিকার। কোন ধরনের নির্যাতন কোথায় হয়, এ প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশ নারীই স্বামীর ঘরে মানসিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেন।
নারী নির্যাতন নিয়ে বিবিএস প্রথম জরিপ প্রকাশ করে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। এরপর ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক নতুন জরিপ সম্পন্ন করেছে বিবিএস। এ জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
অন্যদিকে, ২০১০ সালের পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনে অন্যান্য নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এ আইনের আওতায় মানসিক নির্যাতনের জন্য আইনি সহায়তা চেয়ে মামলার সংখ্যা হাতে গোনা।
২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনের আওতায় করা ৮০টি মামলায় ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেয়। এর মধ্যে ৩২টি মামলা বিশ্লেষণ করেন ব্লাস্টের গবেষক মুহসিনা হোসেন। এতে দেখা যায়, ৩২টির মধ্যে কেবল তিনটিতে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি এবং আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের নারীদের বেশির ভাগই শারীরিক ও অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য নির্যাতনকেই অপরাধ মনে করেন। মানসিক নির্যাতনও যে অপরাধ এবং এই বিষয়ে আইন আছে, সেটাও অনেকে জানেন না। আবার মানসিক নির্যাতন পরিমাপসংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতার ফলেও আইনের ব্যবহার কম হচ্ছে।
২০১০ সালের পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনে মানসিক নির্যাতনের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। এতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবারের অন্য কোনো নারী বা শিশু সদস্য শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতির শিকার হলে একে পারিবারিক সহিংসতা বোঝানো হয়েছে। মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভয় দেখানো বা এমন কোনো উক্তি করা, যার মাধ্যমে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাকে মানসিক সহিংসতা অর্থে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া হয়রানি, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, অর্থাৎ স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশে বাধা দেওয়াও এ নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত। আইনে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি হলে বা ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে আদালতের কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করার বিধান রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিচালক (লিগ্যাল এইড) মাকছুদা আখতার বলেন, ২০১০ সালের আইনটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা এখনো কম। আইনের ব্যবহারটা ততটা বাড়ানো যায়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষিত নারীরা মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি বুঝতে পারলেও বিভিন্ন কারণে আইনি সহায়তা নিতে চান না। এর কারণ হিসেবে রাজধানীর মিরপুরে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্নাতকোত্তর পাস এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীর টাকা আছে, তবে পড়াশোনা আমার থেকে অনেক কম। তাই স্বামী আমাকে চাকরি করতে দেয়নি। সারাক্ষণ আমাকে সন্দেহ করে। মানুষের সামনে আমাকে ছোট করার জন্য যা-তা বলে। শুধু সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করি।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ইনস্টিটিউটে পারিবারিক কলহের কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাঁরা চিকিৎসার জন্য আসেন, তাঁদের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই স্বামীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। মানসিক নির্যাতনের শিকার উচ্চবিত্ত ব্যক্তিরা চিকিৎসার জন্য দ্রুত এলেও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা আসেন অনেক পরে, যখন সমস্যাটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। আর নিম্নবিত্ত ব্যক্তিরা এখানে এ ধরনের সমস্যা নিয়ে আসেন না।
তাজুল ইসলাম আর​​ও বলেন, চিকিৎসার জন্য আসা বেশির ভাগ নারীই জানান, স্বামী তাঁকে হেয় করেন। অবহেলা, অবজ্ঞা করেন। কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে দেন না।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা তৈরি হয়েছে ২০১৩ সালে। আইনটির প্রয়োগকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন মহিলা-বিষয়ক অধিদপ্তরের মহিলা-বিষয়ক কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিকভাবে আইনটির ব্যবহার নেই বললেই চলে। মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায় আরও কম।