Thank you for trying Sticky AMP!!

মর্জিনা আক্তার নামের এই কিশোরী মিরপুর–১৪ নম্বরের একটি ১৪ তলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে

পুলিশ বলছে ‘আত্মহত্যা’, পরিবারের সন্দেহ হত্যা

রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে একটি ১৪ তলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মর্জিনা আক্তার (১৪) নামের এক গৃহকর্মীর মৃত্যু ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ বলছে, মর্জিনা ভবনটির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। তবে মেয়েটির পরিবার বলছে, তার আত্মহত্যা করার কোনো কারণ নেই। তাকে হত্যা করে এখন টাকার জোরে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

মর্জিনা কাজ করত মিরপুর ১৪ নম্বরে পুলিশ স্টাফ কলেজের পেছনে ১৫/ডি, বিজয় রাকিন সিটি নামের আবাসিকের ৫ নম্বর ভবনের ১ নম্বর টাওয়ারের ১৪ তলার ফ্ল্যাটে। তার গৃহকর্তা নাজমুল হুদা রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি।

পুলিশের ভাষ্যমতে, মর্জিনা ১৪ মার্চ বেলা ২টা ৩৬ মিনিটে ওই ভবনের ১৪ তলার ছাদ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে তার লাশের ময়নাতদন্ত হয়। পরে তার পরিবার লাশ নিয়ে লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়।

আজ শুক্রবার সকালে রাকিন সিটিতে গিয়ে ভবনের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ দেখা হয়। তাতে দেখা যায়, ১৪ মার্চ বেলা ২টা ৩৩ মিনিটের দিকে মর্জিনা ১৪ তলার ফ্ল্যাটের সামনের জায়গা দিয়ে ভবনের ছাদে ওঠার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে। ২টা ৩৬ মিনিটে তাকে ভবনটি থেকে নিচে পড়তে দেখা যায়। ছাদে অন্য কেউ ছিল কি না এবং সেখান থেকে মর্জিনা কীভাবে পড়ল, সেই দৃশ্য ফুটেজে নেই।

সাধারণত এ ধরনের ঘটনায় গৃহকর্তার পরিবারের সদস্যদের থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তবে মর্জিনার ক্ষেত্রে তা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, সম্পদশালী গৃহকর্তা নাজমুল হুদা কাফরুল থানাকে ‘ম্যানেজ করে’ অপমৃত্যুর মামলা করিয়েছেন।

সকালে বিষয়টি নিয়ে ওই আবাসিকের বেশ কয়েকজন বাসিন্দার কাছে জানতে চাওয়া হয়। তাঁরা জানান, ১৪ তলার ছাদ থেকে নিচে পড়ে এক গৃহকর্মী মারা যাওয়ার কথা শুনছেন। মর্জিনা যে ভবনের ১৪ তলায় কাজ করত, সেই ভবনের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গেও প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা জানান, ঘটনার সময় কেউ বাসায় ছিলেন না। পরে শুনেছেন, নাজমুল হুদার বাসার গৃহকর্মী ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে।

মর্জিনার মৃত্যুর ঘটনায় কাফরুল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। মামলার বাদী মর্জিনার বাবা আবদুল মালেক। তিনি সপরিবার লক্ষ্মীপুরের কমলনগর থানার চর জাঙ্গালিয়ায় থাকেন। পাঁচ মেয়ের মধ্যে মর্জিনা চতুর্থ ছিল।  

আবদুল মালেক গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আট মাস আগে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে মর্জিনাকে ব্যবসায়ী নাজমুল হুদার বাসায় কাজে দেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, মর্জিনার মৃত্যুর ঘটনায় তাঁকে মামলা করতে হবে, সে বিষয়ে কাফরুল থানা–পুলিশ কিছু বলেনি। পুলিশ শুধু বলেছে, মর্জিনার লাশ নিতে হলে সই দিতে হবে। তাদের কথামতো তিনি স্বাক্ষর করেছেন। তিনি অশিক্ষিত মানুষ। তাঁকে বাদী করে মামলা নেওয়া হয়েছে কিংবা মামলার বিবরণও তাঁকে পড়ে শোনানো হয়নি।

আবদুল মালেক বলেন, ‘হেদের (গৃহকর্তার পরিবার) কথায় মেয়ের মৃত্যু নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। যে ছাদ থেকে মর্জিনা লাফ দিছে বলে হেরা বলতেছে, হেইহানে লাফ দেওয়ার নমুনা পাই নাই। ওর লাফ দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।’

মর্জিনার মৃত্যুর খবর পেয়ে আবদুল মালেকের সঙ্গে তাঁর সেজ মেয়ে আলেয়া বেগমও ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের খবর দিয়ে ঢাকায় নেওয়ার পর প্রথমে লাশ দেখায়নি। আমার বোনকে টর্চার (নির্যাতন) কইরা মেরে ফেলছে। যে ছাদ থেকে মর্জিনা লাফ দিছে বলা হচ্ছে, সেই ছাদে যেতেও দেয়নি আমাকে। তারা বলছিল, মর্জিনা লাফ দিছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, সেই ফুটেজ দেখতে চাইলেও আমাদের দেখানো হয়নি।’  

মর্জিনার পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহকর্তা নাজমুল হুদা আজ প্রথম আলোকে বলেন, মর্জিনার পাশাপাশি বাসায় দুজন গৃহকর্মী কাজ করত। মর্জিনা একজনের মুঠোফোন ও আরেকজনের মুঠোফোনের সিম কার্ড চুরি করলেও পরে অবশ্য তা তাদের ফিরিয়ে দেয়। মর্জিনার বাবা ও বোনের অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি। নাজমুল বলেন, মর্জিনা ছাদ থেকে লাফিয়ে বা পড়ে মারা গেছে। তবে এই কাজ সে কেন করতে গেল, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।  

মর্জিনার পরিবার গরিব, আর তার গৃহকর্তা ক্ষমতাধর ব্যক্তি বলে পার পেয়ে যাবে, এটা হয় না
ফারুখ ফয়সল, নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

সাধারণত এ ধরনের ঘটনায় গৃহকর্তার পরিবারের সদস্যদের থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তবে মর্জিনার ক্ষেত্রে তা হয়নি। অভিযোগে উঠেছে, সম্পদশালী গৃহকর্তা নাজমুল হুদা কাফরুল থানাকে ‘ম্যানেজ করে’ অপমৃত্যুর মামলা করিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফারুকুল আলম আজ প্রথম আলোকে বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে ছাদ থেকে মর্জিনা লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। অন্য যে অভিযোগ উঠেছে, তা মুখরোচক।

তবে মর্জিনা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছে, এমন দৃশ্য সিসি ক্যামেরার ফুটেজে না থাকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তখন ওসি বলেন, ঘটনার তদন্ত শেষে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যাবে।

মর্জিনার গৃহকর্তার পরিবারের সদস্যদের কেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়নি, সে প্রশ্নের জবাবে ওসি ফারুকুল আলম বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদ তো আমরা ওখানেই (ঘটনাস্থল) করেছি। ওই বাড়িতে আরেকটি পরিচারিকা থাকে সে বলেছে, মর্জিনা আগে ফোন চুরি করে ফেরত দিয়েছিল। আজ আবার সিম কার্ড চুরি করে। তাকে বলেছিলাম, তুমি এটা ফেরত না দিলে বাড়ির লোকদের বলে দেব। সে কারণে হয়তো সে কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে।’

এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল। তিনি আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর মর্জিনা আত্মহত্যা করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। মর্জিনার পরিবার গরিব, আর তার গৃহকর্তা ক্ষমতাধর ব্যক্তি বলে পার পেয়ে যাবে, এটা হয় না।’