Thank you for trying Sticky AMP!!

কোকেন পাচারের পথ বাংলাদেশ

১০ বছরে দেশে ৪১ কেজি কোকেন ধরা পড়েছে। এসব কোকেনের গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকা বলেই ধারণা।

বাংলাদেশকে এক দশকের বেশি সময় ধরে কোকেন পাচারের পথ (রুট) হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্র। বাংলাদেশ হয়ে ভারত, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কোকেন পাচার হচ্ছে। গত ১০ বছরে জব্দ কোকেনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এমনটাই ধারণা করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা।

২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশে প্রায় ৪১ কেজি কোকেন ধরা পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩ কেজি কোকেন ধরা পড়েছে গত বছর। আর গত ২৬ জানুয়ারি এক চালানেই ধরা পড়েছে সাড়ে ৮ কেজি। এ ঘটনায় মালাবি, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চক্রের প্রধান নাইজেরিয়ার নাগরিক। তিনি এখনো ধরা পড়েননি।

গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট-২০২৩-এর তথ্য বলছে, বিশ্বে বছরে প্রায় দুই হাজার টন কোকেন উৎপাদন হয়। উৎপাদনকারী তিনটি দেশই দক্ষিণ আমেরিকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬১ শতাংশ কলম্বিয়ায়, ২৬ শতাংশ পেরুতে এবং ১৩ শতাংশ বলিভিয়ায় উৎপাদিত হয়।

ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের চালান ধরা পড়ার অর্থ হচ্ছে দেশে কোকেন আসছে। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় অধিকাংশ চালানই ধরা পড়ছে না। বাংলাদেশে কোকেনের চাহিদা নেই। কারণ, চিকিৎসা নিতে আসা মাদকসেবীদের মধ্যে এখনো কোকেনসেবী পাওয়া যায়নি। এসব রোগীর ইতিহাস পর্যালোচনা করেই দেশে কোন ধরনের মাদকসেবী আছে, সেটা বোঝা যায়। সুতরাং বলা যায়, মাদক পাচারের অপ্রচলিত পথ হিসেবেই বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট-২০২৩-এর তথ্য বলছে, বিশ্বে বছরে প্রায় দুই হাজার টন কোকেন উৎপাদন হয়। উৎপাদনকারী তিনটি দেশই দক্ষিণ আমেরিকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬১ শতাংশ কলম্বিয়ায়, ২৬ শতাংশ পেরুতে এবং ১৩ শতাংশ বলিভিয়ায় উৎপাদিত হয়।

Also Read: এক চালানে পাচার হচ্ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার কোকেন

প্রতিবেদনে বলা হয়, কোকেনসেবী রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ব্যবহারকারীদের ৩০ শতাংশ উত্তর আমেরিকার, ২৪ শতাংশ দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের এবং ২১ শতাংশ ইউরোপের। এ ছাড়া আফ্রিকা ও এশিয়ায়ও সেবনকারী রয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে বেশি কোকেন পাচার হয়। এ ছাড়া সমুদ্র ও আকাশপথে ব্রাজিল হয়ে বিভিন্ন দেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে কোকেন পাচার করা হয়।

পেরুর নাগরিক চার দেশ ঘুরে বাংলাদেশে এসে ধরা পড়েন। তবে এই চালানের গন্তব্য কোন দেশ, সেটি বের করা যায়নি। পেরুর নাগরিকের দায়িত্ব ছিল চালানটি বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়া।
ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের বর্তমান অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটওয়ারী

দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কোকেন পাচারে এগুলো হচ্ছে প্রচলিত রুট। তবে এসব পথে ব্যাপক তল্লাশির কারণে নতুন পথে মাদক পাচারের চেষ্টা করছেন পাচারকারীরা। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে বাংলাদেশ ও ভারতকে ব্যবহার করে ইউরোপ-আমেরিকায় পাচার করা হচ্ছে কোকেন।

কোকেন জব্দের পাঁচটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘটনাতেই বিদেশি নাগরিক গ্রেপ্তার হয়েছেন। এসব কোকেনের চালান দক্ষিণ আমেরিকা থেকে একাধিক দেশ ঘুরে বাংলাদেশে এসেছে। এক দশক আগে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অভিযান চালিয়ে তিন কেজি কোকেনসহ পেরুর এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি।

Also Read: সাগরে ভাসছিল হাজারো কোটি টাকার কোকেন

ওই অভিযানের নেতৃত্বে থাকা ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের বর্তমান অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটওয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, পেরুর নাগরিক চার দেশ ঘুরে বাংলাদেশে এসে ধরা পড়েন। তবে এই চালানের গন্তব্য কোন দেশ, সেটি বের করা যায়নি। পেরুর নাগরিকের দায়িত্ব ছিল চালানটি বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়া।

ডিএনসির গবেষণায় বলা হয়েছে, ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশ মাদকের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল (মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান), গোল্ডেন ওয়েজ (ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, নেপাল ও ভুটানের কিছু অংশ) নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। এতে আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরা বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, বাংলাদেশে মাদক চক্রে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা জড়িয়ে পড়েছেন। গত ১০ বছরে নানা ফৌজদারি মামলায় আসামি হয়েছেন ৩৩ দেশের ৭২৬ নাগরিক। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাইজেরিয়ার, ৯১ জন। এরপর রয়েছে পাকিস্তান (২৮ জন) ও ক্যামেরুনের (১৭ জন)।

বিশ্বজুড়ে আফ্রিকান চক্র

জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে নাইজেরিয়ায় কেবল একটি গুদাম থেকে ১ দশমিক ৮ টন কোকেন উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালের এপ্রিলে আইভরি কোস্টে দুই টনের বেশি এবং কেপ ভার্দেতে সাড়ে ৯ টন কোকেন উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনা থেকে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে মাদক পাচারের পথ হিসেবে আফ্রিকাকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে বাংলাদেশে কোকেনের চালান আসার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ ঢাকায় উদ্ধার সাড়ে ৮ কেজি কোকেন পাচার চক্রের অন্যতম প্রধান হচ্ছেন নাইজেরিয়ার নাগরিক ডন ফ্রাংকি। মাদক পাচারে তাঁর অন্যতম সহযোগী ভাই উইসলি। এ চক্রে আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশের নাগরিকদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, বাংলাদেশে মাদক চক্রে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা জড়িয়ে পড়েছেন। গত ১০ বছরে নানা ফৌজদারি মামলায় আসামি হয়েছেন ৩৩ দেশের ৭২৬ নাগরিক। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাইজেরিয়ার, ৯১ জন। এরপর রয়েছে পাকিস্তান (২৮ জন) ও ক্যামেরুনের (১৭ জন)।

অন্তর্দেশীয় অপরাধী চক্র জড়িত, তদন্ত দায়সারা

ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বশেষ জব্দ চালানের সঙ্গে এখন পর্যন্ত ছয় দেশের নাগরিক জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তদন্তে তাঁদের অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হবে। কারণ, সব তথ্যই গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া গেছে। আবার যেসব ব্যক্তির নাম পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যাচ্ছে না। ফলে কোকেনসহ গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দিতে হবে।

এর আগে কোকেন উদ্ধারের ছয়টি মামলার অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু বাহক বা গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অন্তর্দেশীয় অপরাধী চক্রের সদস্যদের নিয়ে কোনো তদন্ত করা হয়নি। যেমন ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার খিলক্ষেত থেকে ২৫০ গ্রাম কোকেনসহ যে ৬ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কেবল তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। অথচ দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা ওই চালানের গন্তব্য ছিল কাতার।

ডিএনসির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ অঞ্চলের সহকারী কমিশনার সুব্রত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এই চক্রে এক প্রবাসীর সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তবে তাঁর ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি বলে অভিযোগপত্রে তাঁকে রাখা হয়নি।

২০১৫ সালের ৬ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের চালানে কোকেন জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ওই মামলার তদন্তে কোকেনের গন্তব্য বা অন্তর্দেশীয় চক্রকে চিহ্নিত করা যায়নি।

কোকেনের উৎস, গন্তব্য ও অন্তর্দেশীয় চক্র সম্পর্কে তথ্য উদ্‌ঘাটন করতে না পারার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক মাদক চক্র কাজ করে অনেকটা ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে। বাহকেরা জানেন না, এই কোকেনের গন্তব্য কোথায়। তাঁদের দায়িত্ব কেবল নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। ফলে বাহককে ধরলেও আন্তদেশীয় চক্র সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় না।