Thank you for trying Sticky AMP!!

অবৈধ পাথর-বালু ব্যবসা ও যোগাযোগ পর্যটনের বাধা

সিলেটের ব্যবসা–বাণিজ্য–৩

সারি সারি কারখানায় পাথর ভাঙার বিকট শব্দ। পাথর ভাঙার ধুলায় বাতাস ভারী। ভাঙাচোরা সড়কে কেবলই ধুলার রাজত্ব। নদীতে চলছে বালু আর পাথর তোলার উৎসব। জেগে ওঠা চরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একের পর এক ট্রাক। পাথর ও বালু ব্যবসায়ীদের এসব কর্মকাণ্ডে জাফলংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছেছে।
এখানেই শেষ নয়, জাফলং যাওয়ার পথে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে জৈন্তাপুর বাজার পার হলেই ভোগান্তি শুরু। জাফলং পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়কটি খানাখন্দে ভরা। মাঝেমধ্যেই দু-তিন ফুটের গর্ত। অনেক জায়গাতেই কার্পেটিং উঠে গেছে। তামাবিল পয়েন্ট পার হলেই সড়কের ভয়াবহতা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। ভাঙাচোরা ও ধুলাবালির সড়কে দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে খুব সাবধানে চলতে হয় চালকদের।
সব মিলিয়ে পর্যটকদের বিমুখ করতে যতগুলো উপাদান দরকার, জাফলংয়ে তার সব কটিই বেশি মাত্রায় আছে। গত সোমবার দুপুরের পর জাফলংয়ে গিয়ে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতাই হয়েছে। সড়কের ভোগান্তি এবং বালু ও পাথর ব্যবসায়ীদের যন্ত্রণায় এই ভরা মৌসুমেও জাফলং প্রায় পর্যটকশূন্য। পর্যটন মোটেলসহ হোটেলগুলোতে চলছে সুনসান নীরবতা। অথচ এ বছরটি হচ্ছে পর্যটন বর্ষ। পর্যটনের বড় জায়গা হচ্ছে সিলেট।
জাফলংয়ের মতো সিলেটের অন্য দুই পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দি ও রাতারগুলে যেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন পর্যটকেরা। কারণ ওই বেহাল সড়ক। ফলে সিলেটের সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। এসব সমস্যা তুলে ধরে প্রতিবন্ধকতা দূর করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে সিলেট চেম্বারের সভাপতি সালাহ উদ্দিন আলী আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, যোগাযোগব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে সিলেটে পর্যটন খাতের বিকাশ ঘটছে না। ভোগান্তির কারণে একবার একটি পর্যটন কেন্দ্রে গেলে দ্বিতীয়বার আর যেতে চান না পর্যটকেরা। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে সিলেটে হোটেল স্থাপনেই হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। বাকি কাজগুলো সরকারকেই করতে হবে।
সোমবার গিয়ে দেখা যায়, জাফলংয়ের মূল পর্যটন কেন্দ্রের প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার আগে মামারবাজার। সেখান থেকে সড়কের পাশে একের পর এক পাথর ভাঙার যন্ত্র বসিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। জাফলং জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি পর্যন্ত প্রায় ৪০-৫০টি যন্ত্রে বিরামহীনভাবে চলছে পাথর ভাঙার কাজ। কান ফাটানো শব্দ আর ধুলাবালি মিশে পুরো পরিবেশ একাকার। ফলে জাফলংয়ের মূল আকর্ষণ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সবুজ পাহাড় পরিষ্কার দেখাই যায় না।
অন্যদিকে খরস্রোতা ডাউকি নদী শুকনো মৌসুমে খালের মতো হয়ে গেছে। জেগে ওঠা চরে এখানে-সেখানে বিশাল বিশাল গর্ত করে বালু ও পাথর তোলায় ব্যস্ত স্থানীয় মানুষ। এসব বালু ও পাথর আনতে নদীর যে অংশে পানি আছে, সেখানে তৈরি করা হয়েছে ছোট সেতু। তার ওপর দিয়ে ট্রাক যাচ্ছে। নদীর চরে হাঁটার মতো পরিবেশ নেই। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তাকালে মনে হয়, নদীর বুক একদল মানুষ খাবলে খাবলে খাচ্ছে।
জাফলংয়ের জিরো পয়েন্টের কাছে ছয়জন তরুণ পর্যটকের দেখা মিলল। জানতে চাইলে শফিক রহমান নামের এক তরুণ বললেন, ‘অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল জাফলংয়ে আসব। কিন্তু এসে খুবই হতাশ হলাম। মনে হচ্ছে পর্যটকদের জন্য এখানে কিছু নাই। সবই পাথর ব্যবসায়ীরা দখল করে রেখেছেন। ধুলাবালিতে মাখামাখি হয়ে গেছি।’ তাঁর কথায় সায় দিলেন সঙ্গের পাঁচজন।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, ২০০১ সালের পর বালু ও পাথর ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। আর গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে সড়কের বেহাল দশা চলছে। ফলে শীতে পর্যটনের ভরা মৌসুম হলেও জাফলংয়ের প্রতি পর্যটকেরা প্রায় বিমুখ। অন্যদিকে বর্ষাকালে সড়কের অনেক জায়গায় প্রায়ই হাঁটুসমান কাদা থাকে। তখন গাড়ি নিয়ে জাফলংয়ে পৌঁছা অনেকটা অসম্ভব।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিলেটে এসে মানুষ এই শিক্ষা নিয়ে যায়, আমরা সুন্দরকে কীভাবে কুৎসিত করছি। কীভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে হত্যা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে নষ্ট করছি।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, জাফলংয়ের প্রাকৃতিক সম্পদ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করা হচ্ছে। এসব রক্ষায় প্রশাসনের কোনো গরজ নেই। আসলে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এই বালু ও পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন।’
জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাথর ভাঙার জন্য আমরা দুটি নির্দিষ্ট অঞ্চল করতে যাচ্ছি। একটি জৈন্তাপুর উপজেলার ডিবিরহাওর ও অন্যটি তামাবিল এলাকায়। এ ছাড়া তামাবিল এলাকায় একটি ইকোপার্ক করার পরিকল্পনা আছে। এসব হয়ে গেলে জাফলংয়ের সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে। এ জন্য কিছুটা সময় লাগবে।’
সিলেট শহর থেকে জাফলংয়ের দূরত্ব ৫৭ কিলোমিটার। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে এই পথটুকু পাড়ি দিতে এখন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) জানিয়েছে, জাফলং যেতে শেষের ১২ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। তবে সড়কটি সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, পর্যটন স্পট বিছনাকান্দির দূরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। এ দূরত্বের মধ্যে সিলেট সদর উপজেলার এয়ারপোর্ট বাইপাস থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। বছর তিনেক ধরে সড়ক সংস্কারে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হচ্ছে না বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান। আবার সালুটিকর থেকে বিছনাকান্দি পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দূরত্বের সড়কে স্থানে স্থানে রয়েছে অসংখ্য গর্ত। এর বাইরে সারি-গোয়াইনঘাট সড়ক ধরেও বিছনাকান্দি যাওয়া যায়। সওজের অধীন এ সড়কটিও গত মৌসুমের বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
জলারবন খ্যাত রাতারগুলে যেতে হলেও পর্যটকদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সিলেট থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরত্বের এ সড়কের পাঁচ কিলোমিটার অংশই ভাঙাচোরা। এ ছাড়া ওই সড়কের চানুপুর থেকে মোটরঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক কাঁচা। এতে করে বিশেষ করে বৃষ্টির মৌসুমে পর্যটকদের যাতায়াতে চরম সমস্যা হয়।
সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মুনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জাফলং সড়কের ওয়ার্ক অর্ডার ও সারি-গোয়াইনঘাট সড়কের সংস্কারে দরপত্র দেওয়া হয়েছে। সওজের অধীনে থাকা সড়কগুলো চলতি শুষ্ক মৌসুমের সংস্কার করে ফেলা হবে।