Thank you for trying Sticky AMP!!

আলোর পথযাত্রী

মাস্টারদা সূর্য সেন

ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেন এক বিস্ময়কর নাম। গত শতকের তিরিশের দশকে একদল তরুণ বিপ্লবীকে স্বাধিকার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অসম্ভব স্বাধীনতার স্বপ্নে। টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, রেললাইন উপড়িয়ে, অস্ত্রাগার ধ্বংস ও লুণ্ঠন করে, পুলিশ লাইনসের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ শাসনের ভিত। ব্রিটিশ ভারত থেকে চট্টগ্রামকে চার দিন বিচ্ছিন্ন রেখে বুঝিয়ে দিয়েছিল বাংলার অকুতোভয় দামাল ছেলেরা চাইলে যেকোনো অসাধ্য কর্ম সাধন করতে পারে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে পারে। জালালাবাদ যুদ্ধে ১২ জন বিপ্লবীর আত্মদানের মাধ্যমে সূর্য সেন প্রমাণ করলেন, বাঙালি বীরের জাতি, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মৃত্যুকে বরণ করতে সদা প্রস্তুত। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল তাঁর অনুসারী বিপ্লবী তরুণদের দিয়ে চট্টগ্রামের পতন ঘটিয়ে ভারতবর্ষের যুবসমাজের সামনে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সূর্য সেনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ব্রিটিশদের ভারত ছাড় আন্দোলনকে তথা ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পথকে ত্বরান্বিত করেছিল।

চট্টগ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সূর্য কুমার সেন। জন্মেছেন রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ। পড়েছেন গ্রামের দয়াময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নোয়াপাড়া উচ্চবিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম শহরের ন্যাশনাল হাইস্কুলে। শেষোক্ত স্কুল থেকে ১৯১২ সালে মেট্রিক এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯১৪ সালে আইএ পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়ে তিন বছর পড়ালেখা করেও শেষ পর্যন্ত কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন এবং পরে বহরমপুর কলেজ থেকে ১৯১৮ সালে বিএ পাস করেন। এখানে পড়তে গিয়েই সূর্য সেন গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেন।

সূর্য সেন জানতেন পরাধীন রাষ্ট্রে সরকারি চাকরি গ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসনকে সুসংহতকরণে ভূমিকা রাখা আত্মঘাতী কাজ। একজন স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক বিপ্লবী হিসেবে তিনি তা করতে পারেন না। এ কারণে চট্টগ্রামে ফিরে এসে তিনি গুপ্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যুবসমাজকে সংগঠিত করতে থাকেন। একই সময় চট্টগ্রাম ন্যাশনাল স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে বিপ্লবের বাণী পৌঁছাতে শুরু করেন। এ সময় যুব মানসে বঙ্গভঙ্গ রহিত আন্দোলন ও স্বদেশি যুগের আন্দোলনের উদ্দীপনা তৈরি করেছিল। ১৯২০ সালে খিলাফত ও অসহযোগে আন্দোলনের সময় তা আরও বেগবান হয়। চট্টগ্রামের তৎকালীন কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় যাত্রামোহন সেনগুপ্ত, তাঁর পুত্র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শের ই চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার প্রমুখ এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। হিন্দু–মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় চট্টগ্রামের যুবকদের দিয়ে বিপ্লবী দল গড়ে তোলা তাঁর পক্ষে সহজ হয়।

চট্টগ্রামের রাউজানে সূর্য সেনের নামে স্থাপিত ভবন ও স্মৃিত পাঠাগারের সামনে তাঁর আবক্ষ মূর্তি

সূর্য সেন বিপ্লবী তরুণদের শারীরিক শক্তি ও মানসিক মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ও ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করে বিপ্লবীদের দীক্ষা দিতে শুরু করেন। কুস্তিখেলা, লাঠিখেলা, বন্দুক চালানো, বোমা তৈরি ইত্যাদিতে দক্ষ করে তোলেন। তাঁর একনিষ্ঠতা, কঠোর দায়িত্ববোধ এবং জাদুকরি উদ্বুদ্ধকরণ শক্তির কাছে বিপ্লবী তরুণেরা সম্মোহিত হয়ে পড়ে। তাঁর দলে কেবল হিন্দু যুবকেরাই নয়, মুসলমান তরুণ ও শিক্ষিত নারীরাও যোগ দেয়। সূর্য সেন দলের সব পর্যায়ের সদস্যের মতামতের গুরুত্ব দিতেন। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন। বিপ্লবী নেতা হয়েও মাস্টারদা গণতান্ত্রিক নিয়মেই দলকে পরিচালিত করতেন। ক্রমে তিনি সবার কাছে মাস্টারদা হিসেবে গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে ওঠেন।

মাস্টারদার চট্টগ্রাম বিপ্লবে তাঁর অন্যতম সহযোগী ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, সুখেন্দু দস্তিদার, কালী চক্রবর্তী, লালমোহন সেনসহ আরও অনেকে। প্রথম সারির উপরিউক্ত ছয় বিপ্লবী মাস্টারদার সঙ্গে ছায়ার মতো অবস্থান করতেন এবং যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। এসব বিপ্লবীর ব্যক্তিগত চাওয়া–পাওয়া কিছুই ছিল না। প্রায় সবাই ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে, এই ব্রত ছিল সবার মনে। মাস্টারদা অসামান্য ধী-শক্তি ও দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে তাঁর অনুসারী বিপ্লবীদের পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক হিসেবে তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ মাস্টারদা ও তাঁর বাহিনীর জন্য কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। দীর্ঘ প্রস্তুতির মাধ্যমে এগিয়ে চলা এক সফল অভ্যুত্থানের পরিণতি। ১৯০৮ সালে যখন ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়, তখন সূর্য সেন ১৫ বছরের কিশোর। গুপ্ত সমিতি গঠন ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের পর্বেই তাঁর যৌবনে পদার্পণ। বহরমপুরের কলেজজীবনে এসে সূর্য সেনগুপ্ত সমিতিতে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রামের দীর্ঘ ধারার একজন হয়ে উঠলেন। আপসপন্থী ও নরমপন্থী বা সুবিধাবাদীদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দেশ ও জাতির সেবক হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯২৮—এই দীর্ঘ ২০ বছর গুপ্ত সমিতি গঠন, অস্ত্র সংগ্রহ, ব্রিটিশ শাসক ও স্থাপনার ওপর হামলার নানা পরীক্ষা বাংলার বুকে সংঘটিত হয়েছে। বাঘা যতীন ও বালেশ্বরের মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ এই ধারার শেষ অন্যতম ও ব্যাপকতর হিসেবে উদাহরণযোগ্য। এসব প্রচেষ্টা ২০ বছরে এসে থমকে গিয়েছিল। বিকাশের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মাধ্যমে সূর্য সেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিলেন, এটা সাধারণ সন্ত্রাসবাদীর অপরিকল্পিত হামলা নয়, সুশৃঙ্খল বিপ্লবী দলের সুপরিকল্পিত অভ্যুত্থান।

সূর্য সেন ছিলেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক। তাঁর নির্দেশে দেশপ্রেমিক বিপ্লবী যুবক–যুবতীরা প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। যুব বিদ্রোহের সামরিক পরিকল্পনার মূল দায়িত্বে ছিলেন অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষ। সর্বাধিনায়ক হয়েও তিনি এ দুজনের সব সিদ্ধান্ত মেনে নিতেন। ১৮ এপ্রিল অস্ত্রাগার ধ্বংস ও পুলিশ লাইনস দখলের পর অনন্ত ও গণেশ মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সামরিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও সূর্য সেন সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সংকটময় মুহূর্তে তাঁর এই দৃঢ়তা ও কর্তব্যবোধ তাঁকে বিপ্লবীদের নেতা তথা মরণপাগল যুবকদের মাস্টারদাতে পরিণত করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে গেরিলা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছেন। অবশেষে শাসক গোষ্ঠীর প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মাহুতি দিয়েছেন। আর আমাদের জন্য, বাঙালির জন্য তথা ভারতবাসীর জন্য রেখে গেছেন স্বাধীনতার সোনালি স্বপ্ন

আজাদ বুলবুল: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক