Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনায় মারা যাওয়া মুক্তিযোদ্ধার অন্তিমযাত্রায় পদে পদে বাধা

স্থানীয় লোকজনের বিরোধিতার মুখে চিতা সাজানোর কাজ করছেন পুলিশ সদস্যরা। আজ রোববার ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুরস্থ পৌর শ্মশান ঘাটে। ছবি: প্রথম আলো

শ্মশানে লাশ আনার আগেই বাঁশ, কাঠ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে বাধা পেরিয়ে কোনোমতে শ্মশানে নেওয়া হয় লাশ। সেখানেও বাধা। কেউ চিতা সাজাতে রাজি নয়। আগেই চিতার কাঠ পাঠানো হলেও তা ফিরিয়ে দেয় এলাকাবাসী। একে–ওকে ধরে পুলিশ সদস্যরাই সব ব্যবস্থা করেন। নিয়ম অনুযায়ী দাহ করা ব্যক্তির নাম শ্মশানের খাতায় লিপিবদ্ধ করার কথা। সেখানেও বাধা, শ্মশানের কেউ নামটিই লিপিবদ্ধ করতে রাজি নন।

ফরিদপুরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মুক্তিযোদ্ধার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ চক্রবর্তী ফরিদপুর শহরের নিলটুলী মহল্লার বাসিন্দা। তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের নেতাও। ওষুধ ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত ছিলেন তিনি। কমলেশ ফরিদপুর সদরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ও সদর উপজেলা পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সভাপতিও ছিলেন।

আজ রোববার সকাল সাড়ে আটটার দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ চক্রবর্তী ওরফে ভানু (৬৫)। তিনি স্ত্রী, দুই পুত্রসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন রেখে গেছেন।

মুক্তিযোদ্ধা কমলেশের দাহ পূর্ব গান স্যালুট অনুষ্ঠিত হয় শহরের অম্বিকাপুরস্থ পৌর শ্মশানঘাটে। এলাকাবাসীর তীব্র বিরোধিতার মুখে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, বিশেষ করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রাশেদুল ইসলাম ও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুম রেজার হস্তক্ষেপে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ থেকে মুক্তিযোদ্ধা কমলেশের মৃতদেহ নামিয়ে পুলিশ প্রহরায় অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রথমে নিয়ে আসা হয় শহরের নিলটুলীস্থ কালীমন্দির–সংলগ্ন বাড়ির সামনে। সেখান থেকে মৃতদেহটি সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় অম্বিকাপুর শ্মশানঘাটে।

ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রাশেদুল ইসলাম জানান, শ্মশানঘাটে ঢোকার পথে তাঁরা এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়েন। শ্মশানে যাওয়ার সড়কটি এলাকাবাসী আগে থেকেই বাঁশ ও কাঠের গুঁড়ি ফেলে আটকে রাখে। ওই সড়কে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় একজন মানুষের পক্ষে হেঁটে ওই সড়কটি অতিক্রম করার সুযোগ ছিল না। পরে এলাকাবাসীকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে মৃতদেহটি শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়।

রাশেদুল ইসলাম বলেন, কিন্তু এলাকাবাসী দাহকাজের বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। লাশ দাহ করার জন্য পৌরসভার দায়িত্বরত কোনো ব্যক্তিকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আগে কাঠ পাঠানো হলেও এলাকাবাসী সে কাঠ ফিরিয়ে দেন। তাঁরা কোনোভাবেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিকে শ্মশানে দাহ করতে দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।

ফরিদপুর পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ারুল ইসলাম জানান, মরদেহটি অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো, শ্মশানে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো, কাঠ দিয়ে চিতা সাজানো এবং চিতায় মরদেহ স্থাপন সব কাজই করেছেন পুলিশ সদস্যরা। এর আগে পুলিশের পক্ষ থেকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়।

এসআই আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কীভাবে ধর্মীয় রীতি মেনে চিতা সাজাতে হয়, কীভাবে মরদেহ চিতায় তুলতে হয়, এসবের কোনো কিছুই তাঁদের জানা ছিল না। পরে এ কাজে নিয়োজিত পৌরসভার কর্মচারী পরিতোষ সরকারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নিয়মকানুন জানান এবং পুলিশ সদস্যরা তা অনুসরণ করেন। পরে মুখাগ্নি দেন মৃতের ছেলে উজ্জ্বল চক্রবর্তী। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

পুলিশ জানায়, নিয়ম অনুযায়ী ওই পৌর শ্মশানে যাঁর দাহ করা হয়, তাঁর নাম লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। কিন্তু শ্মশানের পরিচালনায় জড়িত কোনো ব্যক্তি নামটি লিপিবদ্ধ করতে রাজি হননি। পরে এগিয়ে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রাশেদুল ইসলাম। তিনি শ্মশানের খাতায় ৯১৩ ক্রমিক নম্বরে লিপিবদ্ধ করেন কমলেশ চক্রবর্তীর নাম।

ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ দুপুরে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলে স্থানীয় কিছু মানুষ সৎকারে বাধা সৃষ্টি করেন। করোনায় মৃত্যুবরণকারীর দেহ শ্মশানে দাহ হতে দেওয়া হবে না বলে তাঁরা দাবি করেন। বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে পুলিশ বাড়ানো হয়। সৎকারের কাজে শ্মশান কমিটি, সৎকার সমিতি বা হিন্দু সমাজের কোনো ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রাশেদুল ইসলাম ও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুম রেজার হস্তক্ষেপে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

ফরিদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার নজরুল ইসলাম জামাল বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শ্মশানে শবদাহে অংশ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন থেকে আমাদের নিরুসাহিত করা হয়। মরদেহ যখন বাড়ির সামনে আনা হয়, তারপরও আমরা দূরত্ব বজায় রেখে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছি।’

এ বিষয়ে অম্বিকাপুর শ্মশান কমিটির সভাপতি লক্ষ্মণ দত্তের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি শুনেছি, কিন্তু যাইনি। করোনা ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে স্থানীয় লোকজন লাশটি দাহ করতে বাধা দিয়েছিলেন।’

ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোর্শেদ আলম বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এলাকাবাসীর আচরণ সুস্থ, স্বাভাবিক ও মানবিক ছিল না। আমরা পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামানের নির্দেশে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ যথাযথ সম্মান জানিয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছি।’