Thank you for trying Sticky AMP!!

কৃত্রিম পায়ে নতুন জীবন

নগরের কালুরঘাট এ কে খান-সিআরপি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে সংযোজন করা হয় কৃত্রিম পা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে। জুয়েল শীল

দুঃসহ সেই স্মৃতিটা আজও টাটকা রোহিঙ্গা তরুণ মো. ইউনূসের কাছে। সেদিন ছিল ২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর। বাঁচার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন মিয়ানমারের মংডুর একটি পাহাড়ে। সেখানেই গুলি করা হয়। সেই গুলি এসে পড়ে তাঁর ডান পায়ে। রক্তাক্ত পা নিয়েই আত্মীয়ের পিঠে চড়ে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। এরপর কেটে ফেলতে হয় সেই পা। 

এত দিন লাঠি কিংবা বাঁশের সাহায্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রে তাঁর কৃত্রিম পা সংযোজন করা হয়েছে। প্রায় আড়াই বছর পর দুই পায়ে হাঁটতে পেরে ইউনূসের মুখজুড়ে উপচে পড়ছিল হাসির ঝিলিক। সেই হাসি নিয়ে বললেন, ‘যেন হারিয়ে যাওয়া পা আবার ফিরে পেলাম।’ 

ইউনূসের জীবন বদলে দেওয়ার পেছনে ছিল ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রসের (আইসিআরসি) অবদানও। বৃহত্তর চট্টগ্রাম তো বটেই, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও এই সেন্টারে প্রতিদিনই অনেকে আসছেন কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য। আর ফিরছেন পা নিয়েই। 

চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর পাশে ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এই কেন্দ্রটি স্বল্প পরিসরে যাত্রা শুরু করে। ২০১২ সালের ২ অক্টোবর চিকিৎসাকেন্দ্রটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। এ কে খান গ্রুপের দেওয়া ৬ হাজার ৩০০ বর্গফুট জায়গার ওপর পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেন্টারের একপাশে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন ইউনিট, অন্য পাশে থেরাপি ইউনিট। দূর থেকে আসা রোগীদের জন্য এখানে রয়েছে ৪০ জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আবাসন-সুবিধা। আছে প্রতিবন্ধীদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের সুযোগও। 

সিআরপিতে এক দিন

সম্প্রতি সিআরপির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, কোনো রোগী আসতেই প্রথমে তাঁর সমস্যা চিহ্নিত করা হচ্ছিল। এরপর আরেকটি কক্ষে নিয়ে পায়ের মাপ নেওয়া হচ্ছিল। অন্য কক্ষে সেই মাপের আদলে নকল পা বানানোর কাজ করা হচ্ছিল। এরপরেই আসে কৃত্রিম পা তৈরির চূড়ান্ত ধাপ। নকল পাটিকে পলিপ্রোপিলিন শিট দিয়ে পেঁচিয়ে গরম তাপে ৪০ মিনিট রাখা হয়। এতে ওই মাপের আদলে কৃত্রিম পা তৈরি হয়ে যায়। সেটিকে ঘষেমেজে নিখুঁত করার পর বেল্টের সাহায্যে সংযোজন করা হয় কাটা পায়ে। এই ইউনিটে সব মিলিয়ে ১৫ জন সদস্য কাজ করছেন। 

এই সেন্টারে তিন ধরনের কৃত্রিম পা সংযোজন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে কাটা পা সংযোজন। কারও কারও কোনো একটি পা জন্মগতভাবে ছোট থাকে। অন্য পায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে সেই ছোট পায়ের সঙ্গে কৃত্রিম পা জোড়া লাগানো হয়। তবে ৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ছোট থাকলে এ ক্ষেত্রে উঁচু জুতা তৈরি করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাঁদের পা বাঁকা তাঁদের একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করে দেওয়া হচ্ছে। যাতে বাঁকা পাটি ধীরে ধীরে সোজা হয়ে যায়। 

সেখানে কৃত্রিম পা সংযোজন করে দেওয়া পাঁচ ব্যক্তিকে হাঁটার অনুশীলন করাচ্ছিলেন কর্মীরা। তাঁদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেনে ডান পা কাটা পড়া মো. ফয়সাল। এই সেন্টারে কৃত্রিম পা সংযোজনের পর একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছেন তিনি। সিলেটের হবিগঞ্জের বাসিন্দা মো. সেলিম মিয়ার আবার জন্মগতভাবে এক পা ছোট। সেই পায়ের সঙ্গে কৃত্রিম পা সংযোজন করা হয়েছে। এখন দুই পায়েই ভর দিয়ে হাঁটতে পারছেন তিনি। বহুদিন পর হাঁটতে পেরে তাঁরা যেন নতুন জীবন পেলেন। 

পুরোপুরি হাঁটতে পারলেই তবে রোগীদের ছাড়পত্র দেওয়া হয় বলে জানান এই ইউনিটের ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন ৮-১০ জন রোগী কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য এখানে আসেন। কৃত্রিম পা সংযোজনের পর তাঁদের কয়েক সপ্তাহ অনুশীলন করানো হয়। পরবর্তীতে নিয়মিত তদারকিও করা হয়। 

১ বছরে ৬৩০ জনের কৃত্রিম পা সংযোজন

গত ৮ বছরে অন্তত ২ হাজার জন এই কেন্দ্রে কৃত্রিম পা সংযোজন করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি কৃত্রিম পা সংযোজন করার ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর ৬৩০ জনের কৃত্রিম পা সংযোজন করা হয়। তাঁদের মধ্যে রোহিঙ্গা ছিলেন ৮৩ জন। 

সিআরপি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে আইসিআরসি। বিশেষ করে কৃত্রিম পা তৈরির উপকরণ খাতে ও রোগীদের আনা–নেওয়ার ক্ষেত্রে এই সংস্থাটি সহায়তা দিয়ে আসছে। আইসিআরসি-এর সহকারী প্রকল্প পরিচালক (শারীরিক পুনর্বাসন) মো. মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই কেন্দ্রের সেবা সম্পর্কে অনেকেই এখনো জানেন না। আমরা চাই বিশেষ করে যেসব শিশুর পা জন্মগতভাবে বাঁকা তাদের যেন অভিভাবকেরা এখানে নিয়ে আসেন। কারণ দ্রুত চিকিৎসা করালে এমন পা ভালো হয়ে যায়।’ 

এ কেন্দ্রে রোগীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করা হয় বলে জানান কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, রোগীর পরিস্থিতি অনুযায়ী তাঁর জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়। অনেককে বিনা মূল্যেও সেবা ও উপকরণ দেওয়া হয়।