Thank you for trying Sticky AMP!!

কেন্দ্রটিরই উন্নয়ন দরকার

ছয় মাসে যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের পাঁচটি শিশু আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। আরও অন্তত আটটি শিশু পালিয়ে যায়।

  • তিন শিশু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কেন্দ্রের ৪ কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।

  • উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনায় দ্রুত পরিবর্তন আনার সুপারিশ প্রশাসনের।

যশোর জেলার মানচিত্র

অপরাধে জড়িয়ে পড়া বা সন্দেহভাজন কোনো শিশুকে কারাগারে না রেখে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সংশোধনের লক্ষ্যে গাজীপুর, টঙ্গী ও যশোরে তিনটি ‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’ করে সরকার। তবে গত বছরের ১৩ আগস্ট যশোরের পুলেরহাটে অবস্থিত শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রটিতে (বালক) পিটিয়ে ৩ শিশুকে হত্যা ও আরও ১৫ জনকে আহত করার অভিযোগ ওঠে সেখানকার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই। এরপর এই কেন্দ্রগুলোর লক্ষ্য এবং পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।

কেবল পিটিয়ে হত্যা নয়, গত ছয় মাসে যশোরের এই কেন্দ্রের পাঁচটি শিশু আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। এ সময়ের মধ্যে সীমানাপ্রাচীর টপকে আরও অন্তত আটটি শিশু পালিয়ে যায়। এই কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে শিশুদের কাছে মাদক বিক্রি এবং টাকার বিনিময়ে অনৈতিক সুযোগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

তিন শিশুকে হত্যার পরে যশোরের জেলা প্রশাসন যে তদন্ত কমিটি করেছিল, সেই কমিটি প্রতিবেদন দিয়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনায় দ্রুত পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছিল। গত সেপ্টেম্বরে ওই প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এর ছয় মাস পরেও এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ৩২টি জেলা থেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়া ও নিরাপদ হেফাজতের জন্য শিশুদের (১৮ বছরের কম বয়সী) পাঠানো হয় যশোরের কেন্দ্রটিতে। বর্তমানে ১৫০ জন ধারণক্ষমতার ওই কেন্দ্রে ৩৩৬ জন অবস্থান করছে। এদের মধ্যে হত্যা মামলায় ১০২ জন, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ৮৭, মাদক মামলায় ৮১, চুরি মামলায় ৩২, অস্ত্র মামলায় ৬ জন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩ জন রয়েছে। এ ছাড়া সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ৭ জন এবং নিরাপদ হেফাজতি ও অন্যান্য মামলায় ১৮টি শিশু রয়েছে।

যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রটির ভেতরে একটি মাত্র ছোট মাঠ রয়েছে। গত সপ্তাহে অনুমতি সাপেক্ষে কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে ১৫ থেকে ২০ শিশু খেলাধুলা করছে। অন্য বেশির ভাগ শিশু নিজেদের কক্ষেই রয়েছে, কেউ অফিস কক্ষের সামনে এলোমেলো ঘোরাফেরা করছে। তাদের খেলাধুলার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। খেলাধুলার সরঞ্জামও তেমন নেই।

জানা গেল, শিশুদের খেলাধুলার সরঞ্জাম যেমন ক্যারম বোর্ড, লুডু, দাবা—এসবের কিছুই দেওয়া হয় না। একটা মাত্র মাঠ, সেখানে একসঙ্গে কয়েকজন খেলা যায়। নাটক, গান, কবিতাসহ কোনো ধরনের সংস্কৃতিচর্চার সুযোগও নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, হতাশা থেকে গত ছয় মাসে পাঁচ শিশু আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ এক শিশু ডিটারজেন্ট পাউডার খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ওই শিশুর বাবা যশোর শহরের পুরোনো কসবা এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘একটি হত্যা মামলায় আমার ছেলের নাম আসে। তাকে নিয়ে আমি আদালতে আত্মসমর্পণ করাই। এরপর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তার জামিন হচ্ছে না। ছেলেটা এখানে থাকতে চায় না। হতাশায় সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।’

এদিকে ছয় মাসে কেন্দ্রের ডরমিটরি ভবনের জানালার গ্রিল ভেঙে ও সীমানাপ্রাচীর টপকে অন্তত আট শিশু পালিয়ে যায়। কেন শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যা ও পালানোর প্রবণতা বাড়ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে দ্রুত জামিন না হওয়া ও পরিবারের উদাসীনতার কারণে শিশুদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। যে কারণে তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রের সীমানাপ্রাচীরের পাশে থাকা গাছ ও আবাসন কক্ষের জানালার গ্রিল ভেঙে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবার তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এরপর সীমানাপ্রাচীর সংলগ্ন সুপারিসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ অপসারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

মাদক বেচে আনসার

কেন্দ্র সূত্র জানায়, এখন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নিরাপত্তা প্রহরী থাকলেও কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তার কাজটি মূলত পুলিশ ও আনসার সদস্যরাই করে থাকেন। এখন ওই কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন ২১ জন আনসার সদস্য। এঁদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে কেন্দ্রের শিশুদের কাছে নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আনসার সদস্যরা বিভিন্ন সময় তাদের বাইরে যাওয়ার সুযোগসহ নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ।

গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মাদক বিক্রি ও শিশুদের অনৈতিক সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে দুই আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে। তাঁরা হলেন নূর হোসেন ও হারাধন কুমার বিশ্বাস।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) অসীত বিশ্বাস বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের বদলি করা হয়েছে।’

তদন্ত কমিটির সুপারিশমালা

গত আগস্টে তিন শিশু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কেন্দ্রের ৪ কর্মকর্তাসহ ১২ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ইতিমধ্যে ওই চার কর্মকর্তাসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চার শিশুর বিরুদ্ধে পৃথক দোষীপত্র দিয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য যশোরের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবুল লাইছকে আহ্বায়ক করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি ১০টি সুপারিশসংবলিত তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় গত ১ সেপ্টেম্বর।

সুপারিশে বলা হয়েছে, কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য সুনির্দিষ্ট কাঠামোর আওতায় নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ১৮ বছরের বেশি বয়সের কেউ যাতে কেন্দ্রে অবস্থান করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু দালিলিক প্রমাণের ওপর নির্ভর না করে স্বাস্থ্যগত পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। দীর্ঘদিন আটক থাকার কারণে কিছু শিশুর মধ্যে হতাশা লক্ষ করা গেছে। এদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে ব্লেড বা ধারালো জিনিসপত্র দিয়ে নিজেদের শরীর স্বেচ্ছায় কেটে ফেলাসহ অস্বাভাবিক আচরণ করে। এদের নিয়মিত কাউন্সেলিং (পরামর্শ) করতে হবে।