Thank you for trying Sticky AMP!!

গরু পালন করে পুষ্ট পাঁচ গ্রাম

গরুর খামারে ব্যস্ত সময় পার করছেন খামারিরা। বীরগঞ্জের সাহাডুবি গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুরে এবার আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির উপযোগী উৎপাদিত গরু ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৫টি। এর মধ্যে শুধু বীরগঞ্জের ১৬ হাজার ১১৪টি। আর শিবরামপুর ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের গরু ৬ হাজার ৩৬৯টি। অর্থাৎ এ উপজেলায় উৎপাদিত মোট গরুর প্রায় ৪০ শতাংশ এই পাঁচ গ্রামের।

দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় গরুর খামারি রয়েছেন ৬০ হাজার ৫২০ জন। এর মধ্যে শুধু বীরগঞ্জের রয়েছেন ৫ হাজার ৩৬৮ জন। আর শিবরামপুরের ওই পাঁচ গ্রামে রয়েছেন ১ হাজার ২৭৭ জন খামারি। অর্থাৎ এ উপজেলার প্রায় ২৫ শতাংশ খামারিই ওই পাঁচ গ্রামের।

এই পাঁচ গ্রাম হলো মুরারীপুর, সাহাডুবি, আরাজি মিলনপুর, ভেলাপুকুর ও গণপৈত। এসব গ্রামে প্রায় দেড় হাজার পরিবারের বাস। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবার গরু পালন করে। প্রতিটি পরিবারে সর্বনিম্ন ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৩০টি পর্যন্ত গরু রয়েছে। দেশি গরুর পাশাপাশি রয়েছে ফিজিয়ান, শাহিওয়াল ও সংকর জাতের।

জেলা শহর থেকে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার দূরে শিবরামপুর ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের ওই পাঁচ গ্রামের মানুষ আগে চাষবাসসহ নানা কাজে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে গরু পালন তাঁদের প্রধান পেশায় পরিণত হয়েছে। সারা বছর গরু পালন করলেও কোরবানি ঈদ ঘিরে তাঁদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সংসারের কাজের পাশাপাশি গরুর যত্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নারীরা।

এখানকার লোকজন বলেন, এখানকার লোকজনের ঘুম ভাঙে গরুর হাম্বা রবে। গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই থমকে দাঁড়ান। কারণ প্রতিটি বাড়িতেই আছে গরু ও খামার। তবে এখানকার মানুষদের বাণিজ্যিকভাবে গরুর খামার গড়ে তোলা বেশি দিন আগের কথা নয়। অল্প সময়ে খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন তাঁরা। উদ্বুদ্ধ হয়েছেন একে অপরকে দেখে।

সম্প্রতি দেখা যায়, ওই পাঁচ গ্রামে প্রায় ঘরে ঘরে গরুর খামার। অনেকের খামার না থাকলেও তিন থেকে পাঁচটি করে গরুর গোয়াল রয়েছে। এসব খামার ও গোয়ালে গরুর পরিচর্যা করছেন নারী ও পুরুষেরা। কেউ গরুকে খাবার দিচ্ছেন। কেউ খামার ও গোয়াল পরিষ্কার করছেন।

সাহাডুবি গ্রামের শামিম মিয়ার বাড়িতে দেখা যায়, স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি ছোট একটি ঘরে থাকেন। তবে গরুর জন্য ১১৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থের টিনশেডের খামার করেছেন। শামিম বলেন, দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা শহরে রিকশা চালাতে যান তিনি। বছরখানেক বাদে বাবা আবদুস সালামের ডাকে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর হাতে অন্যের গরু পালন করে ভাগে পাওয়া একটি বাছুরের দড়ি তুলে দেন বাবা। পাঁচ মাসের মাথায় সেই বাছুর তিনি বিক্রি করেন ১২ হাজার টাকায়। এ টাকায় ছোট দুটি বাছুর কেনেন তিনি। এরপর দুটি থেকে চারটি, ছয়টি, আটটি। এভাবে ২১টি গরুর মালিক এখন তিনি। প্রতিটি গরুর মূল্য ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা।

একই গ্রামের নবী হোসেন (৭০) বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর ধরে গরু পালন করছি। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে পালন শুরু করেছি ১০ বছর ধরে। এখন শরীর আর চলে না। দুই ছেলেকে দুটি খামার করে দিয়েছি। পাকা ঘর তুলেছি। ৫ বিঘা জমি কিনেছি। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এর সবই করেছি গরু বিক্রির লাভের টাকায়।’

শিবরামপুর ইউনিয়নের গরু দিনাজপুরের ফাসিলাডাঙ্গা, ফার্মেরহাট, বীরগঞ্জ, কাহারোল ও গোলাপগঞ্জ, পঞ্চগড়ের বোদা এবং ঠাকুরগাঁওয়ের খোঁচাবাড়িসহ বেশ কয়েকটি হাটে বিক্রি হয়। অনেক সময় গরুর পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা গ্রামে এসেও গরু কিনে নিয়ে যান।

মুরারীপুর গ্রামের মো. হাশিম উদ্দিন বলেন, বীরগঞ্জের গোলাপগঞ্জ আর ঠাকুরগাঁওয়ের খোঁচাবাড়ি হাট শিবরামপুরের গরু না গেলে জমেই না।

জেলার অতিরিক্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোছা. আশিকা আকবর গতকাল সোমবার বলেন, এবার ঈদে দিনাজপুরে গরুর চাহিদা ৮২ হাজার ২৬৭টি। চাহিদার তুলনায় ৩৭ হাজার ৬৯৮টি গরু বেশি উৎপাদিত হয়েছে। এসব গরু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।

খামারিরা জানান, কোনো ক্ষতিকর ইনজেকশন ও ট্যাবলেট ব্যবহার না করে দেশীয় পদ্ধতিতে ভুট্টার গুঁড়া, গমের গুঁড়া, খৈল, ভুসি ও কাঁচা ঘাস খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণ করেন তাঁরা। এর সঙ্গে খড়, চিটাগুড় ও পানির সঙ্গে পরিমাণমতো ইউরিয়া মিশিয়ে গরুকে তিন বেলা খাওয়ান তাঁরা। এ ইউনিয়নে গরুর স্বাস্থ্যসেবায় নিযুক্ত রয়েছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের প্রতিনিধি। তিনি প্রতিদিন রুটিন অনুযায়ী খামারিদের বাড়িতে গিয়ে গরুকে টিকাদানসহ অন্যান্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

জানতে চাইলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহীনুর আলম বলেন, ‘২০০৯-১০ অর্থবছরে মুরারীপুর গ্রামে ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্টের আওতায় ২০ জনকে নিয়ে গরু পালনের একটি দল করা হয়। এই দলের সদস্যদের আমরা সিআইজি (কমিউনিটি এক্সটেনশন ওয়ার্কার) বলি। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁদের দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হন। ক্রমে খামারির সংখ্যা বেড়ে গেলে আমরা সেখানে ইউনিয়ন সম্প্রসারণ প্রতিনিধি নিয়োগ করি। বর্তমানে প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে গরুর স্বাস্থ্যসেবার পরামর্শ দানসহ যাবতীয় ভ্যাকসিন ও টিকা বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে এখানকার খামারিরা গরু পালন করে নিরাপদ মাংস উৎপাদনে ভূমিকা রাখছেন।’