Thank you for trying Sticky AMP!!

সুনামগঞ্জে বন্যায় ভেঙে যাওয়া নিজের ঘরের সামনে শান্তনা বেগম। জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মনিপুরী হাটি গ্রামে

ঘর মিশে গেছে মাটির সঙ্গে, তিন ছেলে নিয়ে বেঁচে থাকাতেই সান্ত্বনা খুঁজছেন তিনি

ঘর ভেঙে মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। আজীবনের শ্রমে–ঘামে জড়ানো জিনিসপত্রের কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। স্বামী আর ছোট তিন ছেলে নিয়ে দুই দিন ছিলেন নৌকায়। খাওয়া নেই, ঘুম নেই। তবুও সান্ত্বনা বেগমের (৩৫) সান্ত্বনা একটাই, সবাইকে নিয়ে বেঁচে আছেন।

সান্ত্বনা বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের মণিপুরী হাটি গ্রামে। বন্যার পানির তীব্র স্রোতে গ্রামটি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। গ্রামে এমন কোনো ঘর নেই যেটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ভেঙে গেছে দোকানপাট, গাছপালা। বাড়িঘরের আঙিনা, সড়কে গর্ত হয়েছে। ঢলের সঙ্গে নামা বালুর স্তূপ জমে আছে সবখানে। গ্রামের অসহায় মানুষ আছে থাকা-খাওয়ার কষ্টে।

সান্ত্বনা বেগমের স্বামী আমির হোসেন শ্রমজীবী। সান্ত্বনা নিজেও গ্রামের পাশের নদীতে বালু তোলার কাজ করেন মাঝেমধ্যে। তাঁদের তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে তাসকিনের বয়স (৮)। তাঁদের গ্রামে পানি বাড়তে থাকে ১৭ জুন সকাল থেকে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে পুরো গ্রাম তলিয়ে যায়। গ্রামের ভেতর দিয়েই গেছে ঢলের পানির তীব্র স্রোত।

বহু বছরের চেষ্টায় ঘর করছিলাম। আর কবে পারমু জানি না। এখন কই যাইমু, কই থাকমু, এইটা নিয়া বড় চিন্তায় আছি
আমির হোসেন, শ্রমজীবী

আমির হোসেন জানান, সেদিন বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়, বজ্রপাত হচ্ছিল। পরিবেশটাই ছিল ভয়ের। পানি ঘরে ঢোকার পর পার্শ্ববর্তী মুসা মিয়ার ঘরে যান তাঁরা। একপর্যায়ে সেখানেও পানি ওঠে। পরে চারটি পরিবার একটি নৌকায় আশ্রয় নেন। প্রবল বৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল নৌকাটিও ডুবে যাবে। চোখের সামনেই ঘরের সবকিছু ভেসে যাচ্ছিল। ঘরটিও ভেঙে পড়েছিল। তিন বছর আগে পাকা পিলার দিয়ে টিনের ঘরটি বানিয়েছিলেন তিনি। আমির হোসেন বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। বহু বছরের চেষ্টায় ঘর করছিলাম। আর কবে পারমু জানি না। এখন কই যাইমু, কই থাকমু, এইটা নিয়া বড় চিন্তায় আছি।’

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সান্ত্বনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের এর–ওর ঘরে এখন রাত কাটান তাঁরা। কেউ দিলে খান, না দিলে তিন ছেলেকে নিয়ে উপোস থাকেন। সকাল থেকে ছেলেরা কোনো কিছু খায়নি। চার বছরের তানভীর মায়ের কাপড় ধরে ভাতের জন্য তখন কাঁদছিল। সান্ত্বনা বেগম বলেন, ‘দুই দিন নৌকাত আছলাম। মনে অইছিল কিয়ামত শুরু অইছে। তিনটা ছেলেরে বুকে নিয়া আছলাম। সন্তানেরা বুকে আছে, এইটাতেই শান্তি।’

মণিপুরী হাটি গ্রামটি এলাকার চলতি নদীর পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি এই গ্রামে ১৩০টির মতো ঘর আছে। এর মধ্যে ৩২টি পুরোপুরি বিধ্বস্ত। গ্রামের মানুষের বেশির ভাগই দরিদ্র শ্রমজীবী। নদীতে বালুশ্রমিকের কাজ করেন তাঁরা। গ্রামের বাসিন্দা বাছির মিয়া (৫৬) প্রথম আলোর এ প্রতিবেদককে পুরো গ্রামটি ঘুরে দেখালেন। এর সঙ্গে পুরোপুরি ভেঙে পড়া ৩২টি ঘরের মালিকদের নাম ধরে ধরে হিসাব দিলেন। গ্রামের মাঝামাঝি গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে থাকা একটি ঘর দেখিয়ে নিজেই আফসোস করলেন ‘এই পরিবারটা বড়ই অসহায়’। জানালেন এটাই আমির হোসেন ও সান্ত্বনা বেগমের ঘর। বাছির মিয়া বলেন, ঘরের পরে সড়ক ছিল। পরে নদী। প্রথমে সড়ক ভাঙছে, পরে পানি এসে ঘর ভেঙে দিয়েছে।

সুনামগঞ্জে বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় গৃহহীন হয়ে পড়া লোকজন। জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মনিপুরী হাটি গ্রামে

আমেনা বেগম (৫৫) নিজের ঘরটির বেহাল দেখিয়ে আঁচলে চোখ মুছতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘হায়রে স্রোত। সঙ্গে বৃষ্টি আর বাতাস। মানুষ যে যেভাবে পারে আগে জান বাঁচাইছে। রাইত অইলে অনেক মানুষ মরত।’

মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে পরিবারের ছয় সদস্যকে নিয়ে ছেলের শ্বশুরবাড়ি আশ্রয় নিয়েছেন ইসমাইল হোসেন (৭০)। তিনি বলেন, ‘পরের বাড়ি আর কয়দিন থাকমু, খাইমু। আর যাইমু কোয়াই। ঘর বানানোর সামর্থ্যও নাই। এখন পথে নামত অইব।’
গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি আবদুল মজিদ (৮৫) বলেন, ‘আমার জীবনে এত ভয়ংকর বন্যা দেখছি না। পুরা গ্রামটারে তছনছ করি গেছে। মানুষের খাওন নাই, ঘর নাই। আবার ঘর বানানোর মতো কারও সামর্থ্যও নাই।’

আবদুল মালেক (৬০) নামের এক ব্যক্তি নিজের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি দেখানোর জন্য শুরু থেকেই এ প্রতিবেদককে চাপাচাপি করছিলেন। নিজের উঠানে দাঁড়িয়ে পাশের একটি উঁচু জায়গা দেখিয়ে বলেন, যখন বাড়ির ভেতর দিয়ে বন্যার পানির স্রোত যাচ্ছিল, তখন ওই বাঁশ ঝাড়ের নিচে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেন। চোখের সামনে সব গেছে। ৬০ মণ ধান ছিল। সব ভেসে গেছে। ঘরের জিনিসপত্র ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে।

Also Read: সুনামগঞ্জে পুলিশ ও র‌্যাব প্রধানের ত্রাণ বিতরণ

গ্রাম থেকে বের হওয়ার পথে দক্ষিণ মাথায় কয়েকজনকে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা করছিলেন মোবারক হোসেন (৫২) ও আমিরুল ইসলাম (৬০)। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমার ঘরটা দেখে আসেন। স্টিলের অ্যাঙ্গেল ঝুলে আছে। দুই বছর আগে সাত লাখ টাকা দিয়া ঘর বানাছিলাম। এখন মাটিতে মিশে আছে। ঘরের লগে বন্যা আমারেও মাটিত মিশাইছে।’

Also Read: পানি কমায় স্বস্তি, আছে দুর্ভোগও

আমিরুল ইসলাম জানান, গত মঙ্গলবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসে কিছু চাল-চিড়া দিয়ে গেছেন। তাও সবাই পাননি। গ্রামে ত্রাণ আসছে কম। আলোচনা শহর নিয়ে বেশি। অথচ গ্রামের মানুষ অভুক্ত।

শহরে ফেরার পথে উপজেলার ভাদেরটেক, বালুচর গ্রামেও অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত দেখা গেছে। এসব গ্রামের মানুষও বলেছেন তাঁরা প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাদি উর রহিম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর উপজেলায় অন্তত পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে মণিপুরী হাটি গ্রামে ২০টি, ভাদেরটেকে ১৫টির মতো হবে। উপজেলায় ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।

Also Read: পানি নামলেও ভাঙাচোরা ঘরে ফিরতে পারছেন না আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষ