Thank you for trying Sticky AMP!!

ঝুঁকিপূর্ণ ঘিঞ্জি গলিতে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা

হোসিয়ারির প্রধান কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটির সরু রাস্তার দুই পাশের বাড়ি ঘেঁষে বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন তারের জটলা। এর মধ্যে চলছে বেচাকেনা। ছবি: ​দিনার মাহমুদ

নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি ব্যবসায়ীদের এখন যেন দম ফেলারও সময় নেই। ঈদের বাজার ধরতে দিনরাত কাজ চলছে। এখানে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়। এর অর্ধেকই হয় ঈদুল ফিতরের সময়। এর মধ্যেই সারা দেশ থেকে মাল কিনতে আসছেন ব্যবসায়ীরা।

প্রায় ১০০ বছর আগে নারায়ণগঞ্জ শহরে গড়ে ওঠে হোসিয়ারি পল্লি। এখান থেকে সারা দেশে যায় হোসিয়ারি পণ্য। নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটি এলাকা হচ্ছে এই ব্যবসার মূল কেন্দ্র। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘিঞ্জি গলিতে গাদাগাদি করে গড়ে উঠেছে বাড়ি। তাতেই কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্র। রাস্তা এত সংকীর্ণ যে গাড়ি ঢোকার উপায় নেই। এখানে মূলত দেশীয় সুতায় বোনা কাপড়ে গেঞ্জি ও অন্তর্বাস তৈরি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিশুদের পোশাক ও টি-শার্ট।

বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. নাজমুল আলম প্রথম আলোকে জানালেন, এখানকার হোসিয়ারি শিল্পে বছরে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। এর প্রায় ৫০ শতাংশই হয় ঈদুল ফিতরে। ঈদুল আজহা এবং পূজা-পার্বণও তাঁদের বিক্রির মৌসুম। তিনি বলেন, গত বছর ব্যবসা খারাপ গেছে। এবার তাঁরা আশা করছেন, বিক্রি ভালো হবে। লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন ৭০০ কোটি টাকার।

দেশের ৯০ ভাগ হোসিয়ারি পণ্য এখানে তৈরি হলেও এটা এখনো ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে বিবেচিত। নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটি মূল কেন্দ্র হলেও এখন পাশের উকিলপাড়া ও দেওভোগ এলাকায়ও হোসিয়ারি পণ্য তৈরি ও বিক্রি হয়। এর মধ্যে নয়ামাটিতে গেঞ্জির পাশাপাশি এখন টি-শার্টও তৈরি হয়। উকিলপাড়ায় স্যান্ডো গেঞ্জি বেশি। দেওভোগে মূলত গার্মেন্টসের কাটা কাপড়ে শিশুদের পোশাক তৈরি হয়।

নয়ামাটির পুরোনো ব্যবসায়ী বৃষ্টি হোসিয়ারির মালিক মো. আবদুল হাই প্রথম আলোকে বলেন, রোজার ঈদটাই তাঁদের মূল মৌসুম। বছরের কয়েক মাস তাঁদের বসে থাকতে হয়, বিক্রি থাকে না।

পাট যখন দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল, তখন নারায়ণগঞ্জকে বলা হতো ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’। সেটা এখন ইতিহাস। এখন নারায়ণগঞ্জের অন্যতম পরিচয় দেশের হোসিয়ারি শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। সরকারের জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে জানা গেছে, ১৯২১ সালে সতীশ চন্দ্র পাল নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে প্রথম হোসিয়ারি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে নয়ামাটিতে এর বিকাশ ঘটে।

বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, এখন তাদের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান সাড়ে তিন হাজার। এর বাইরে ছোট ছোট আরও পাঁচ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান আছে। মোট প্রায় সাড়ে আট হাজার প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছেন প্রায় তিন লাখ শ্রমিক।

এই শিল্পকে কেন্দ্র করে অন্তত চার হাজার সুতার দোকান নিয়ে বিরাট বাজার গড়ে উঠেছে শহরের টানবাজারে। এর সঙ্গে ডাইং ব্যবসাও জড়িত। কাপড় তৈরির পর সেটা পরিষ্কার করতে ও রং করতে পাঠানো হয় ডাইং কারখানায়। তারপর সেই কাপড় কেটে পোশাক তৈরি করে বাজারজাত করা হয়।

ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ব্যবসায়ীদের

হোসিয়ারির হাত ধরে নারায়ণগঞ্জে রপ্তানিমুখী নিটওয়্যার শিল্পের বিকাশ। এখানকার নিটওয়্যার শিল্পমালিকদের বড় অংশ একসময় হোসিয়ারি ব্যবসায় ছিলেন। কিন্তু হোসিয়ারি সেই পেছনেই পড়ে আছে। ব্যবসায়ও আগের মতো লাভ নেই বলে জানালেন ব্যবসায়ী বাদল চন্দ্র ঘোষ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবিষ্যৎ ভালো দেখছি না। দেশের অন্যত্র হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। নিম্নমানের হোসিয়ারি পণ্য আমাদের ঝুঁকিতে ফেলছে। আমার লোকনাথ নিটিংয়ের আটটি মেশিন আছে, এখন চলছে মাত্র একটি।’

বাদল ঘোষের তিন প্রজন্ম এই ব্যবসায় তাঁর বাবা রাধাচরণ ঘোষই ছিলেন ৪০ বছর। এখন বাদল ঘোষের ছেলে প্রীতম ঘোষও যুক্ত হয়েছেন। প্রীতম বললেন, ‘সরকার রপ্তানিমুখী বাণিজ্যে যে সুবিধা দেয়, আমাদের সেটা দিতে চায় না। সেটা পেলে হয়তোবা আমরা টিকে যেতাম।’

>

১০০ বছর আগে শহরে গড়ে ওঠে হোসিয়ারি পল্লি
চলছে সরু গলিতে গাদাগাদি করে, আছে অগ্নিঝুঁকি
বছরে লেনদেন ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা

এখানকার আরেক পুরোনো ব্যবসায়ী বিপুল হোসিয়ারির মালিক অশোক কুমার সাহাও এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। তিনি জানালেন, ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। এখানে ব্যবসার বড় অংশ হয় বাকিতে। ৩০ চৈত্র হালখাতায় বকেয়া আদায় হয়। এবার হালখাতায় আদায়ও ভালো হয়নি। তিনি বলেন, ‘অনেক শ্রমিক ও কর্মকর্তা এখন মালিক হয়েছেন। প্রতিযোগিতাও বেড়েছে।’

একসময় হোসিয়ারিপল্লিতে মূলত গেঞ্জি ও অন্তর্বাস তৈরি হতো; যা সম্পূর্ণ দেশীয় সুতায় কাপড় বুনে করা হতো। কেবল গেঞ্জি দিয়ে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে ওঠায় গত কয়েক বছরে হোসিয়ারির পাশাপাশি অনেকে তৈরি পোশাক কারখানার কাটা কাপড়ের টি-শার্ট, বাচ্চাদের পোশাক তৈরিতে যুক্ত হয়েছে। এখানে অনেকে শ্রমিক থেকে মালিক হয়েছেন। ছোট ব্যবসায়ী যেমন আছেন, বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও আছে এখানে। কেউ কারও জন্য হুমকি নয়।

হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কবির হোসেনের মতে, ‘সরকার পাটশিল্পের পুনর্জাগরণের সহায়তা দিচ্ছে। রপ্তানিমুখী গার্মেন্টসকে প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা কুটিরশিল্প হিসেবেও কোনো সুবিধা পাচ্ছি না। সরকার সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে ঋণ দিলে বিনিয়োগ বাড়িয়ে এখনো এই ব্যবসার প্রসার সম্ভব।’

অগ্নিঝুঁকিতে নয়ামাটি
শত বছরের এই হোসিয়ারিপল্লি এখনো সেই ঘিঞ্জি গলিতে গাদাগাদি করে আছে। নয়ামাটির সরু রাস্তার দুই পাশের বাড়ি ঘেঁষে বিদ্যুৎ, টিঅ্যান্ডটি, স্যাটেলাইট কেব্‌লসহ বিভিন্ন তারের জটলা। এখানে আগুনের বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে বলে জানালেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নয়ামাটি হোসিয়ারিপল্লির সরু গলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। পানির উৎস না থাকায় আগুন লাগলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আছে। এ ছাড়া হোসিয়ারির সম্প্রসারিত এলাকা উকিলপাড়া ও দেওভোগ মার্কেটও রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে।

এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল আলমও। তিনি বলেন, এখানে কোনো বাড়িতে বজ্রনিরোধক দণ্ড নেই। ফলে বজ্রপাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও আছে। তাঁর মতে, সিটি করপোরেশন চাইলে এখানকার রাস্তা চওড়া করতে পারে। তবে সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম আলোকে বলেন, সেখানকার বাড়ির মালিকেরা জায়গা ছাড়তে রাজি হননি। তাঁরা জায়গা ছাড়লে সিটি করপোরেশন রাস্তা প্রশস্ত করে দেবে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, সবাই ঘরে ঘরে অগ্নিনির্বাপণ সিলিন্ডার রেখে নিজেদের নিরাপদ ভাবছে। কিন্তু এই সিলিন্ডার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নেই। এখানে অগ্নিনির্বাপণের কোনো মহড়াও হয় না।

বৃষ্টি হোসিয়ারির মালিক মো. আবদুল হাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে আগুন লাগলে পুরান ঢাকার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা হবে। মাল বাঁচানো তো দূরের কথা, জান নিয়েও বের হতে পারব না।’