Thank you for trying Sticky AMP!!

ঢাকা অভিমুখে ছুটছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। শনিবার বেলা ১১টার দিকে দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটে।

ঢাকামুখী মানুষের ঢল, ভিড় কমাতে সহায়তা করলেন হিজড়ারা

পোশাক কারখানাসহ রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রোববার (১ আগস্ট) থেকে খোলা রাখার ঘোষণায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ঢাকা অভিমুখে ছুটছেন। শনিবার সকাল থেকেই রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে মানুষের ঢল নামে। ভিড় সামাল দিতে হিজড়াদের সহযোগিতা নেওয়া হয়। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে কঠোর বিধিনিষেধে আটকে ছিলেন কর্মজীবী এই মানুষেরা।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক দিয়ে রিকশা-ভ্যান, নছিমন, করিমন, অটোরিকশা, মাহেন্দ্র, প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস—যে যেভাবে পারছেন, সেভাবে দৌলতদিয়া ঘাটে আসছেন। ফেরিঘাটে মানুষের ভিড়ে কোথাও দাঁড়ানোর জায়গাটুকু ছিল না। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া থেকে আসা ফেরিতে থাকা যানবাহনগুলো মানুষের ভিড়ে নামতেই পারছিল না।

শনিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় অবস্থান করে দেখা যায়, প্রতিটি ঘাটে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। কোথাও পা ফেলার জায়গাটুকু নেই। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে মানুষজন বিভিন্ন উপায়ে ফেরিঘাটে এসে নামছেন। প্রখর রোদের মধ্যে ফেরির পন্টুনের ওপর দাঁড়ানোর জায়গা না পাওয়ায় অনেকে আশপাশের রাস্তা বা দোকানপাটের ঝাপের নিচে আশ্রয় নিচ্ছেন। একদিকে প্রখর রোদ, আরেক দিকে গরম—এরপরও মানুষে গিজগিজ করছে। কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। কিছু সচেতন মানুষ থাকলেও এক পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের বারবার দুই হাত জীবাণুমুক্ত করতে দেখা যায়। এ ছাড়া আগত যাত্রীরা ফেরি না পেয়ে এ ঘাট ছেড়ে ওই ঘাট, আবার ওই ঘাট ছেড়ে এ ঘাটে ছোটাছুটি করতে থাকেন। এ সময় ফেরির স্বল্পতা দেখে যাত্রীদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গোয়ালন্দ ঘাট থানা–পুলিশ, দৌলতদিয়া নৌ ফাঁড়ি পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিসির স্টাফদের যাত্রীদের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। তবে তাঁরা ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাটুরিয়া থেকে তিন-চারটি পণ্যবাহী গাড়ি, চারটি প্রাইভেট কার নিয়ে রো রো (বড়) ফেরি ভাষাশহীদ বরকত দৌলতদিয়ার ৫ নম্বর ঘাটে ভিড়ে। তার আগে ঘাটের পন্টুন থেকে শুরু করে সংযোগ সড়ক, এমনকি ওপরের পাকা সড়কে মানুষে গিজগিজ করছিল। বারবার ফেরি থেকে মাস্টার মাইকে পন্টুন থেকে যাত্রীদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করছিলেন। কিন্তু মানুষের শোনার সময় ছিল না। ফেরিতে থাকা যানবাহন নামানোর পরিবেশ তৈরি করতে মাইকে ঘাট এলাকায় কর্তব্যরত পুলিশের সহযোগিতা চান ফেরির চালক। তারপরও কোনো ব্যবস্থা হচ্ছিল না। একপর্যায়ে প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার পর ফেরি থেকে যানবাহনগুলো উচ্চ মাত্রায় হর্ন বাজিয়ে পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে নামতে সক্ষম হয়। এসব গাড়ি নামার আগেই ফেরিতে যাত্রীরা হুড়মুড় করে উঠে পড়েন।

ফেরিতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। শনিবার বেলা ১১টার দিকে দৌলতদিয়া ফেরি ঘাট এলাকায়।

এভাবে বড় ফেরিটিতে অন্তত কয়েক হাজার যাত্রী ওঠেন। যাত্রীর ভিড়ে একটি যানবাহনও উঠতে পারেনি। এমনকি মানুষের ভিড়ে ফেরির ডালা পর্যন্ত তুলতে পারছিলেন না চালক। মাইকে বারবার ডালার ওপর থেকে মোটরসাইকেলসহ মানুষজনকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন চালক। কিছুতেই সরানো সম্ভব হচ্ছিল না। পরে ঘাট এলাকায় থাকা হিজড়াদের সহযোগিতায় মোটরসাইকেলসহ মানুষকে নামানো হয়। এভাবে এক ঘণ্টার কসরতের পর ডালা তুলে ঘাট ছেড়ে যায় ফেরি।
মাথায় ব্যাগ নিয়ে ঝিনাইদহ থেকে আসা ঢাকাগামী দুই যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কিসের লকডাউন? এই যদি হয় লকডাউন, তাহলে এত হাজার হাজার মানুষ এল কীভাবে? আপনারা লকডাউন দেবেন, আবার গার্মেন্টস খুলে দেবেন। আমাদের তো যেতেই হবে। এখন যত কষ্টই হোক।’

সাভারের আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মিনা আক্তার। সকালে মাইক্রোবাসে করে জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে ভাড়া দিয়ে আসেন দৌলতদিয়া ঘাটে। দৌলতদিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটে আলাপকালে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই বিধিনিষেধ এবং করোনার মধ্যে কেন বাড়ি গিয়েছিলেন? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পবিত্র ঈদুল ফিতরের সময় আমরা কেউ বাড়ি যেতে পারিনি। এই কোরবানির ঈদে লম্বা ছুটি পাওয়ায় ছুটি ঘোষণার পরদিন বাড়ি চলে আসি।’ পথে কোথাও কোনো ঝামেলা বা বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন কি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পথে দুই জায়গায় পুলিশের বাধার মুখে পড়েছিলাম। গোয়ালন্দ মোড় থেকে পুলিশ মাইক্রোবাসের চালকের কাগজপত্র রেখে দিয়েছে। যদি লকডাউন মানতেই হয় তাহলে গার্মেন্টস খুলে দিল কেন?’

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক এনামুল ইসলাম গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ থেকে যাচ্ছিলেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘শুক্রবার রাত আটটার দিকে খবর আসে রোববার থেকে গার্মেন্টস খোলা। এই খবর আরও আগে দিত। রাতের বেলা রওনা দিয়া পরদিন কীভাবে যাব? আবার গাড়িঘোড়া চলছে না। তাহলে গার্মেন্টসের প্রায় ২৫-৩০ লাখ শ্রমিক কীভাবে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঝিনাইদহ থেকে প্রায় তিন গুণ ভাড়া দিয়ে এসেছি। করোনার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের কয়েকজন মিলে একত্রে যাচ্ছি। এখন কিছুই করার নাই। না গেলে তো চাকরি থাকবে না।’

সকাল ছয়টার দিকে ঝিনাইদহ থেকে গাজীপুরগামী পোশাক কারখানার আরেক শ্রমিক শাহাদত হোসেন বলেন, ‘গতকাল রাতে অফিস থেকে মেসেজ দিছে ১ তারিখ থেকে গার্মেন্টস খোলা, যেতে হবে। এখন যেহেতু চাকরি করি, তাই যেভাবেই হোক যেতে হচ্ছে। ভোরে রওনা হয়ে বিভিন্ন রাস্তার চিপাচাপা দিয়ে অনেক কষ্ট করে এসেছি। তারপরও পথে পুলিশের অনেক বাধা পেয়েছি।’

ফেরিঘাট এলাকায় আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল তায়াবীর অনেকটা অসহায়ের সুরে বলেন, ‘এত মানুষ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? তারপরও আমাদের পুলিশ সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যতটুকু সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করছেন।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ভাই আমরা খুব বিপদে আছি। অনেক কিছু বলতে পারছি না। আগে আটটি ফেরি চলছিল। মাঝেমধ্যে এমন কিছু নির্দেশনা আসে, আমরা এখন কোন দিকে যাব, কিছুই বুঝতে পারছি না। হাজার হাজার মানুষ নদী পাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে নেমেই “আমাদের ঢাকা পাঠান” বলে আন্দোলন করছেন, “মারামারি করছেন”। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আছি। তারপরও যত দূর সম্ভব ফেরি চালাচ্ছি।’