Thank you for trying Sticky AMP!!

তাঁরা বিক্রি হতে এসেছেন

এক বেলার জন্য তাঁরা বিক্রি হন। গত বৃহস্পতিবার সকালে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডে। ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড। ভোরে ফজরের আজানের পুবদিগন্তে আলো ফুটছে। পথঘাট সবে ফরসা হয়ে আসছে। আর তখনই একদল মানুষ আসতে শুরু করেন এই বাসস্ট্যান্ডে। না, তাঁরা কোনো বাস ধরবেন না। যাবেন না দূরে কোথাও। তাঁদের কারও হাতে কোদাল। কারও হাতে দা অথবা কাস্তে। কারও হাতে কিছুই নেই। শক্তপোক্ত একটা শরীরই সম্বল। ধীরে ধীরে একটা জটলার মতো হয়। তাঁদের কেউ বসে কেউবা দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি খুঁজে ফেরে ক্রেতাদের। তাঁরা দিনমজুর। এক দিনের জন্য বিক্রি হতে এসেছেন এখানে।

গৃহস্থসহ আরেক শ্রেণির মানুষ এখানে আসেন তাঁদের কিনে নিতে। চলতে থাকে দরদাম। দাম ওঠানামা করে অন্য আর দশটা পণ্যের মতোই। একসময় দুই পক্ষের সমঝোতা হয়। এভাবে চলে শ্রম বিকিকিনি।

বিক্রি হওয়া এসব মানুষকে স্থানীয় ভাষায় কেউ বলেন ‘বদলি’। কেউ বলেন ‘কামলা’। আবার কেউ ডাকেন স্রেফ ‘শ্রমিক’ বলে। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত চলে শ্রমিক কেনার এই বাজার।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দাউদকান্দি, তিতাস, চান্দিনা, মুরাদনগর ও চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার অভাবী লোকজন কাজের খোঁজে এখানে এসেছেন। তবে তাঁদের বেশির ভাগই বিক্রি হন এক বেলার জন্য।

বর্তমানে এই অঞ্চলে গোল আলু আবাদের জন্য জমি তৈরি করা, আমনসহ অন্যান্য পাকা ধান কাটা, রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করা, জমি পরিষ্কার করাসহ অন্যান্য কাজে এই ধরনের শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এই শ্রমিকেরা সকাল থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত কাজ করার জন্য মৌখিক চুক্তিবদ্ধ হন। এই সময়সীমাকে এক বেলা হিসেবে ধরা হয়। এক বেলা গতর খাটার বিনিময়ে একজন শ্রমিককে গৃহস্থ দুই বেলা খাবার দেবেন। এর বাইরে ধান কাটার জন্য একজন শ্রমিককে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে ৪৫০ টাকা। জমির আগাছা পরিষ্কার করার কাজে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, রাজমিস্ত্রির জোগালিকে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা, বোঝা টানার কাজের জন্য ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দেওয়া হয়।

>

গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত বসে শ্রমিক কেনার এই বাজার
ধান কাটার জন্য একজন শ্রমিককে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে ৪৫০ টাকা
জমির আগাছা পরিষ্কার করার কাজে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, রাজমিস্ত্রির জোগালিকে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা

গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডে গত বৃহস্পতিবার সকালে কথা হয় দাউদকান্দির রায়পুর গ্রামের নবীর হোসেন ও চান্দিনার শব্দলপুর গ্রামের অলিউল্লাহর সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এই এলাকায় শ্রমের দাম বেশি, কাজও বেশি। প্রতিদিন নিজের শ্রম বিক্রি করা যায়। তাই এখানে স্বেচ্ছায় চলে আসেন। তবে এক বেলার জন্য কাজে গেলেও মহাজনেরা তাঁদের একটুও বিশ্রাম দিতে চান না, পারলে রাত পর্যন্ত খাটানোর বাহানা করেন।

দাউদকান্দি উপজেলার বানিয়াপাড়া গ্রামের আবদুল হক অভিযোগের সঙ্গে বলেন, তাঁকে প্রায়ই ভোর পাঁচটার পর থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত টানা কাজ করতে হয়। তবু মালিকেরা সন্দেহের চোখে দেখেন। পারলে যন্ত্রের মতো তাঁকে খাটাতে চান।

দাউদকান্দির ইছাপুর গ্রামের আলাউদ্দিন বলেন, বাজারে চাল-ডালসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। তবে এখন তাঁরা যে টাকা পাচ্ছেন, মোটামুটি সংসার চলে। মাঝেমধ্যে কাজ জোটে না। তখন সংসার চলে না।

এদিকে বদলি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মালিক পক্ষের অভিযোগও কম নয়। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার গুয়াগাছিয়াকদমতলী গ্রাম থেকে আসা আবদুস সাত্তার বলেন, হালের এই কামলারা সাহেবের মতো আচরণ করেন। তাঁরা ঘড়ি দেখে কাজ শুরু করেন। হাতের কাজ শেষ হতে না হতেই ঘড়ি দেখে কাজ ফেলে রেখে চলে যান। চুক্তি অনুযায়ী টাকা তাঁদের ঠিকই দিতে হয়।

দাউদকান্দির নুরুপুর গ্রামের বাসিন্দা মহাজন নূরে আলম বলেন, ‘জমির ইজারা, সার, বীজ ও কামলার দাম বৃদ্ধি পেলেও আমরা মহাজনেরা ফসল বিক্রির সময় সঠিক দাম পাচ্ছি না। এই অবস্থায় বছরের পর বছর লোকসান দিতে দিতে কৃষিকাজ ছেড়ে দেওয়ার জোগাড় হয়েছে।’