Thank you for trying Sticky AMP!!

দুর্যোগে ঈদ ভালো কাটেনি ভোলার চরাঞ্চলের মানুষের

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি। ঈদের দিনও বাড়িঘর মেরামতে ব্যস্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা। ঢালচর ইউনিয়ন, চরফ্যাশন, ভোলা, ২৫ মে। ছবি: সংগৃহীত

প্রথমত করেনাভাইরাস (কোভিড-১৯) স্বাভাবিক জীবনকে প্রায় অচল করে দিয়েছে। তারওপর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের হানায় ঘরবাড়ি হয়েছে লন্ডভন্ড। ভেসে গেছে গবাদিপশু-পাখি ও ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। সেই সঙ্গে নদী ভাঙন ও নদীতে দুই মাস (মার্চ-এপ্রিল) মাছ শিকার বন্ধ থাকায় দেখা দিয়েছে অর্থ সংকট। এসব দুর্যোগ আর সংকটের কারণে এবারের ঈদ ভালো কাটেনি ভোলার চরাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের।

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সর্ব-দক্ষিণে সাগর মোহনার ঢালচর ইউনিয়নের ভদ্রপাড়ার বাসিন্দা কাঞ্চন মাঝি। তিনি বলেন, 'ঈদের দিন ব্যানে (সকালে) গায়-গোছলদি নজ (নামাজ) পড়ি, আই (আমি) হারাদিন গর (ঘর) সারোনের কামে আছিলাম। ডাবনা পাতার ঘর আছিল আর। হেই ঘর ভাঙি গেছে। দমায় (ঢেউ) ঘরভিডার মাডিও লোই গেছে। এহোন বিরাণ ভিডা পরি আছে। হোলাইনের লাই জামা-কাপড় দূরে থাউক, নাস্তা হানিও খাওয়াইতাম হারিনো।'

মার্চ-এপ্রিল মাস মেঘনা নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল বলে জানান কাঞ্চন মাঝি। তিনি আরও জানান, মাছ ধরা বন্ধের সময়ে আসে করোনাভাইরাস। ফলে ঢালচর থেকে তিনি বের হতে পারেননি। নদীতে মাছ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হতে না হতেই সাগরে মাছ ধরার ওপর আসে নিষেধাজ্ঞা। আর নদীও মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আসে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। ঝড়ের রাতে তার ঘর ভেঙে গেছে। মাত্র আড়াই ভান টিন পেয়েছেন কোস্টগার্ডের কাছ থেকে। কিন্তু কোনো খাদ্যসহায়তা পাননি। তাই ঈদের দিনে সন্তানদের কোনো রকম স্বাদ-আহ্লাদই পূরণ করা যায়নি।

ঈদের নামাজ পড়তে পারেননি বলে জানান ঢালচরের ফারুক বাতান। আম্পানের প্রভাবে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে তাঁর পাঁচটি মহিষ ভেসে গেছে। বসতঘর দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। খুঁজতে খুঁজতে ঈদের দিন পর্যন্ত দুটি মহিষ পেয়েছেন। এখনো বাকি তিনটি মহিষ খুঁজছেন। তাই সকাল হলেই মালিকের মহিষসহ নিজের মহিষগুলো খুঁজে ফিরছেন ফারুক। তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে ঝড়ের আগের দিন আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এসেছেন। ঝড়ের রাতে নিজের ঘর দুমড়ে-মুচড়ে গেলে তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই নেন। ঘরের টিন ছাড়া কিছুই খুঁজে পাননি। ভাঙনে নদী ঘরভিটার কাছে এসে পড়েছে। তাই এখানে নতুন করে ঘর তোলা সম্ভব নয়। যেতে হবে নতুন কোনো ভিটায়। মহিষের সঙ্গে নতুন ভিটারও খোঁজ চলছে।

ফারুক বাতান ও কাঞ্চনের মতো ঢালচরের ইউনিয়নের সব পরিবার কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আম্পানের প্রভাবে। তবে যাঁদের ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, ঈদের দিনও তাঁরা ঘর মেরামতেই ব্যস্ত ছিলেন। এসব মানুষের আয়ের একমাত্র মাধ্যম মাছ শিকার, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি রেখে মাছ শিকারে যেতে পাচ্ছেন না।

ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, আম্পানের প্রভাবে ঢালচরের ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রত্যেকটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই চরের মানুষের ঈদ ভালো কাটেনি। তিনি বলেন, গত ৫-৬ দিনে কমপক্ষে ৫০ একর জমি ভেঙেছে। এমনিতেই ভাঙন প্রবণ ইউনিয়নের তিন দিক থেকে ভাঙছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ইউনিয়নের তিন শতাধিক ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। চার শতাধিক পুকুর ডুবে মাছ চলে গেছে। গবাদিপশু ভেসে গেছে। এ অবস্থায় তিনি সরকারি-বেসরকারিভাবে ৩০০ লোককে ত্রাণ দিতে পেরেছেন। টিন দিয়েছেন পাঁচজনকে। এখন ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্তদের টিন ও নগদ টাকা দেওয়া দরকার।

ঢালচরের মতো অবস্থা, চর নিজাম, কুকরি-মুকরি, চর পাতিলা, মুজিবনগরের চর সিকদারের। লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের চর শাহজালাল ও চর কাচুয়ার। মনপুরা উপজেলার চর কলাতলি, তজুমদ্দিন উপজেলার চর জহিরুদ্দিন, চর মোজাম্মেল, বাসনভাঙার চর, দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর, মদনপুর, নেয়ামতপুর, এবং ভোলা সদর উপজেলার মাঝের চর, রামদাসপুর, চরচটকিমার, চর হোসেন, গাজীর চরের।

কেমন ঈদ কেটেছে জানতে চাইলে চর শাজালারের জসিম উদ্দিন বলেন, 'আল্লাহ তৌফিক দিছে ঈদের নামাজ পড়ানোর, হেই আলহামদুলিল্লাহ। বসত ঘর খান কাইত অই গেছে, চাপা পড়লে কিয়াত্তাম।'

ক্ষতিগ্রস্ত চরবাসী জানান, করোনায় আর ঘূর্ণিঝড়-বন্যায় দুবেলা দুমুঠো খেতে পাওয়াই কষ্টসাধ্য। সেখানে ঈদে নতুন জামা-কাপড়, ফিন্নি-পায়েসের আশা করা বোকামি। যিনি রান্না করেছেন, তিনি পাঁচ ঘর নিয়ে খেয়েছেন। আর যার সামর্থ্য আছে, তিনি একটু বেশি খেয়েছেন। ঈদ তো শেষ। এখন ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পালা।

চরের বাসিন্দা নাসিম মাঝি (৩৫) বলেন, ঈদের আগে সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের লালমোহনে নিয়ে কয়েক জনকে ১০ কেজি করে চাল দিয়েছেন। কিন্তু উপজেলা শহরে যেতে জনপ্রতি ৩০০-৩৫০টা খরচ হয়েছে। এখন তাদের টিন আর নগদ টাকা দরকার।

ভোলা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, জেলায় প্রায় দুই হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের জন্য মন্ত্রণালয়ে টিন ও নগদ টাকার বরাদ্দ চেয়েছেন।