Thank you for trying Sticky AMP!!

দৃষ্টিহীন আমিনুল এখন সফল ব্যবসায়ী

নিজ দোকানে ক্রেতাকে পণ্য দেখাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম। সাম্প্রতিক ছবি। প্রথম আলো

দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। কেউ কিনছেন বিদ্যুতের তার। কেউবা কিনছেন বৈদ্যুতিক বাতি। আবার কেউ এসেছেন পুরোনো মুঠোফোন মেরামত করার জন্য। ক্রেতাদের চাহিদা ও পছন্দমতো জিনিসপত্র দেখানো ও তা বিক্রি করা নিয়ে ব্যস্ত দোকানি আমিনুল ইসলাম (৩৪)। ক্রেতারা নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে মালপত্র বের করে দিচ্ছেন এবং বিনিময়ে টাকাও গুনে নিচ্ছেন তিনি। আমিনুল সবকিছুই করছেন না দেখে। কারণ, দুই চোখে তিনি কিছুই দেখতে পান না।

অন্যের বোঝা না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো দৃষ্টিহীন আমিনুল এখন এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে আদর্শ। অনেকেই তাঁকে দেখে অবাক হন। তিনি মুঠোফোন হাতে নিলেই এর নাম এবং মডেল নম্বর বলে দিতে পারেন। পণ্য বেচাকেনার টাকা গণনার জন্যও তাঁর কারও সাহায্য লাগে না। যেকোনো নোট হাতে নিয়ে নিজেই পরিমাণ বলে দিতে পারেন।

পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্বে সীমান্তঘেঁষা রতনীবাড়ি বাজারে আমিনুল ইসলামের দোকান ‘মা মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস’। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে দৃষ্টিহীন আমিনুল এখন এই বাজারের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।

আমিনুল ইসলাম পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের ফুলবরপাড়া এলাকার মজিবর রহমানের ছেলে। জন্মের পর ভালোই ছিল আমিনুলের দুই চোখ। দরিদ্র দিনমজুর বাবার সংসারে সাত ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছিলেন আমিনুল। সাত বছর বয়সে হঠাৎ একদিন তাঁর চোখে বালু ঢুকে যায়। অভাবের কারণে সুচিকিৎসা হয়নি। ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যান আমিনুল।

১৫ বছর বয়সে আমিনুলের বাবা কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন দিনাজপুরের একটি চক্ষু হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, আমিনুলের চোখ দুটি নষ্ট। নতুন চোখ প্রতিস্থাপন করলে হয়তো তিনি দেখতে পেতে পারেন। এতে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হবে। এরপর টাকা না থাকায় ফের বন্ধ হয়ে যায় চিকিৎসা।

এরপর শুরু হয় দৃষ্টিহীন আমিনুলের জীবনের সংগ্রাম। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন গাছে উঠতে পারতেন আমিনুল। প্রায়ই স্থানীয় লোকজনের গাছের সুপারি পাড়ানোর ডাক পড়ত আমিনুলের। গাছ থেকে সুপারি পাড়ানোর কাজ করে সামান্য আয় তুলে দিতেন দিনমজুর বাবার হাতে। ২০১০ সালের দিকে স্বল্প পুঁজি দিয়ে কলার ব্যবসা শুরু করেন আমিনুল। পরে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মুরগি কিনে তা বিক্রি করতেন হাটবাজারে। এ ছাড়া পাইকারি দরে চকলেট কিনে ছোট ছোট প্যাকেট করে বিক্রি করতেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও গ্রামে।

২০১২ সালে মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে আমিনুল শুরু করেন মুঠোফোন যন্ত্রাংশের ব্যবসা। রতনীবাড়ি বাজারে পাঁচ হাজার টাকা জামানত দিয়ে একটি দোকানঘর ভাড়া নেন। প্রতি মাসে ভাড়া ৩০০ টাকা। পাঁচ হাজার টাকার মালপত্র তুলে শুরু করেন ব্যবসা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমিনুলকে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাঁর ব্যবসার পরিধি। দোকানের মুঠোফোন মেরামতের কাজ করেন তাঁর ভাতিজা রানা ইসলাম।

ওই দোকানের পাশে ২০১৭ সালে দুই লাখ টাকা দিয়ে জমি কেনেন আমিনুল। এখন তিনি নিজের জমিতে বড় দোকান দিয়েছেন। তাঁর দোকানে এখন নতুন মুঠোফোন সেট, বিদ্যুতের বাল্ব, তার, কটপিন, হেডফোন, চার্জার, মেমোরি কার্ড, ব্যাটারিসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। আগে আমিনুলকে পঞ্চগড় শহর থেকে দোকানের মালপত্র কিনতে যেত হতো। ব্যবসায়িক সফলতা পাওয়ায় বিভিন্ন কোম্পানিই এখন চাহিদা অনুযায়ী তাঁকে পণ্য সরবরাহ করছে। এতে তাঁর যাতায়াত খরচ ও কষ্ট কমেছে।

মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আমিনুলের পরিবার। পৈতৃক ভিটায় বাড়িও নির্মাণ করেছেন তিনি। আমিনুল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার ব্যবসার প্রতি ঝোঁক ছিল। শূন্য হাতে শুরু করে এত দূর এসেছি। আমি অন্ধ হওয়ায় ক্রেতারাই আমাকে সহযোগিতা করেন। মালামাল নিয়ে সঠিকভাবে টাকা দিয়ে যান। কেউ কোনো দিন আমার অমঙ্গল চাননি। স্বল্প লাভে পণ্য বিক্রি করি। এ কারণে ক্রেতারাও বেশি আসেন। লাভ কম হলেও বিক্রির পরিমাণ বাড়ে। বর্তমানে খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আমার ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। আর্থিক সহায়তা বা ঋণ পেলে ব্যবসা আরও এগিয়ে নিতে পারব।’

সম্প্রতি আমিনুলের দোকানে গিয়ে কথা হয় ক্রেতা জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বিদ্যুতের তার এবং বাল্ব কিনতে এসেছেন। তিনি বলেন, আমিনুলের দোকানে ভালো মানের এবং সঠিক দামে মালপত্র পাওয়া যায়। তিনি (আমিনুল) চোখে দেখেন না। কিন্তু পণ্যের নাম বললে কারও সহযোগিতা ছাড়াই তা বের করে দিতে পারেন।

রতনীবাড়ি বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক হাসান বলেন, ‘দৃষ্টিহীন আমিনুল ইসলাম কারও কাছে হাত না পেতে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমাজে অনেকেই আছেন, যাঁদের শরীরের সব অঙ্গ ঠিক থাকার পরও অন্যের বোঝা হয়ে থাকেন। আমিনুল তাঁদের জন্য আদর্শ। তাঁকে দেখে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। যেকোনো সমস্যায় তাঁর সঙ্গে আছি, থাকব।’