Thank you for trying Sticky AMP!!

দেশি স্বাদের নতুন কই

বাজারে কই মাছের অন্ত নেই। আকারেও তেমন। কিন্তু খেয়ে কি আর আশ মেটে? ‘দেশি কই দেশি কই’ একটা অতৃপ্তি থেকেই যায়। অনেকে স্মৃতির পাতা উল্টে দেশি কইয়ের স্বাদ নিয়ে কিতাবি ঢঙে বলেন, ‘আহ, একদা খেয়েছিলুম বটে!’ তবে এই আফসোসের দিন ফুরিয়ে আসছে। দেশি স্বাদের নতুন এক প্রজাতির কই উদ্ভাবন করেছেন দেশের মৎস্য গবেষকেরা।

মাছে–ভাতে বাঙালি। এতে উত্তম সংযোজন কই মাছ। বাঙালির রসনা বিলাসে কই মাছ খুবই জনপ্রিয় খাবার। ভাজি, ভর্তা, ভুনা, ঝোল—এক কইয়েই কত পদ! তবে বাজারে আজকাল গোলগাল পুরুষ্ট যেসব কই পাওয়া যায়, এতে আসল স্বাদ পাওয়া দায়। কারণ, এসব মাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। খাওয়ানো হয় এমন সব খাবার, নদী-খাল-বিলে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছের মতো অতটা স্বাদের হয় না।

এ জন্য চাষের কইয়ের চেয়ে দেশি কইয়ের জন্য সমঝদার লোকজনের হা-পিত্যেশ রয়েই গেছে। আর মাছচাষিরা কোমর কষে উন্নত জাতের কই চাষে মন দেওয়ায় দেশি কইয়ের আবাস–সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে এগুলো হয়ে উঠেছে দুষ্প্রাপ্য। বাজারে দেখা যায়, এক কুড়ি দেশি কইয়ের কলজে–কাঁপানো দাম হাঁকছেন মাছ বিক্রেতা।

বাজারে চাষের বলে পরিচিত ঢাউস যেসব কই মেলে, এগুলো আসলে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে আনা। এসব কই মাছে সারা দেশের পুকুর-ডোবা সয়লাব। অন্যদিকে, দেশি কই মাছের দেখা মেলে বর্ষাকালের শেষে যখন নদ-নদী, খাল-বিলের পানি শুকিয়ে যায়। তখন জলাধারে ধরা পড়ে অল্পস্বল্প দেশি কই।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে কই মাছের জাত উন্নয়নে গবেষণা চলছে।

আশার কথা হলো, দেশি কই মাছ নিয়ে হতাশা দূর করার চেষ্টা চলছে। গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা। গবেষণার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহের বিজ্ঞানীরা কই মাছের এমন একধরনের প্রজাতির উদ্ভাবন করেছেন, যা দেখতে এবং স্বাদে অনেকটা দেশি কই মাছের মতো। তাঁদের আশা, এর চাষ শুরু হলে দেশে কই মাছের উৎপাদন ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

দেশি কইয়ের অবস্থা করুণ
এ দেশের স্বাদু পানির খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, ধানখেতে একসময় প্রচুর কই মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, কই এখন বিপন্ন প্রজাতির মাছ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন স্বাদু পানির মাছ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে কই মাছ থেকে আসে ৫৩ হাজার ৫৫৩ মেট্রিক টন, যা স্বাদু পানির মোট মাছ উৎপাদনের মাত্র ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

দেশি কই গেল কই?
স্বাদে যেমন অনন্য, তেমনি পুষ্টিকর এবং চর্বি কম থাকায় কই মাছের কদর সবাই করেন। জীবন্ত অবস্থায় বাজারে পাওয়া যায়, তাই অন্য মাছের চেয়ে কই মাছের দাম তুলনামূলক বেশি। দাম বেশি হলেও এ দেশের খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, হাওর-বাঁওড়, এমনকি ধানখেতেও প্রচুর কই মাছ পাওয়া যেত। জলাশয়ে থাকা আগাছা, কচুরিপানা, ডালপালার ভেতর কই মাছ বেশ স্বচ্ছন্দে বাস করে। জলাশয় ও ধানখেতের পোকামাকড় কই মাছের প্রধান খাদ্য। কিন্তু উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে ব্যবহৃত কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচের জন্য বাঁধ নির্মাণ, প্রাকৃতিক জলাশয়ে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়া, শিল্পকারখানার বর্জ্যে পানিদূষণ—এসব বিরূপ পরিস্থিতির কারণে দেশি কই প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

হারিয়ে যেতে থাকা দেশি প্রজাতির কই মাছ ফিরিয়ে আনতে ২০০০ সাল থেকে গবেষণা শুরু করে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। মৎস্য গবেষকেরা দেখতে পান, প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ করতে গিয়ে পুকুরে দেশি কই মাছের দৈহিক বৃদ্ধি খুব কম। চার-পাঁচ মাস চাষ করে এক হেক্টর আয়তনের পুকুর বা জলাশয় থেকে দেড় থেকে দুই মেট্রিক টন কই মাছ পাওয়া যেত। কম উৎপাদন ও খরচ বেশি হওয়ায় দেশি কই মাছ চাষে আগ্রহ হারান চাষিরা।

নতুন প্রজাতির কই
২০০৩ সালে থাই কই মাছের চাষ শুরু হয়। থাই কই মাছের দৈহিক বৃদ্ধি দেশি কই মাছের দ্বিগুণ, উৎপাদন খরচও কম। তা ছাড়া তিন থেকে চার মাসে চাষ করে প্রতি হেক্টর থেকে প্রায় সাত মেট্রিক টন থাই কই মাছ পাওয়া যেত। এরপর ২০১১ সালে ভিয়েতনামের কই মাছ চাষ শুরু হয়। হেক্টরপ্রতি ভিয়েতনামের কই মাছ পাওয়া যায় ১৫ মেট্রিক টন। তাই চাষিরা দেশি ও থাইল্যান্ডের কই মাছ বাদ দিয়ে ভিয়েতনামের কইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তা ছাড়া থাই কই মাছের শরীরে কালো ফোঁটা ফোঁটা চিহ্ন থাকে, যা এসব মাছকে দেশি কই থেকে আলাদা করে চিনতে সহায়তা করে। ভিয়েতনামের কই মাছ দেখতে অনেকটা দেশি কই মাছের মতো। সব মিলিয়ে ভিয়েতনামের কই মাছের উৎপাদন বাড়তে থাকে। কিন্তু বেশি লাভের আশায় অল্প জায়গার জলাশয়ে বেশি পোনা ছাড়তে শুরু করেন অনেক চাষি। এ কারণে ভিয়েতনামের কই মাছের জাত নষ্ট হয়ে যায়। তাই ২০১৫ সালে কই মাছের জাত উন্নয়নের গবেষণা শুরু করে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে কই মাছের জাত উন্নয়নে গবেষণা চলছে।

পরীক্ষামূলকভাবে ভিয়েতনামের পুরুষ কইয়ের সঙ্গে দেশি মা কইয়ের ক্রস ব্রেড (মিশ্রণ) করানো হয়। এতে যে ধরনের কই পাওয়া গেল, তা অনেকটাই দেশি কই মাছের দেখতে। এই কই মাছের পেটে দেশি জাতের মতো হলদে রং থাকে। খেতেও দেশি কই মাছের মতো। নতুন জাতের কই মাছের উৎপাদন দেশি কইয়ের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। ভিয়েতনামের কইয়ের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ কম। একটি পূর্ণবয়স্ক দেশি কইয়ের ওজন হয় প্রায় ৫০ গ্রাম। কিন্তু মিশ্র প্রজাতির নতুন কই মাছের ওজন হয় ৯০ গ্রাম থেকে ১০০ গ্রাম। তবে মিশ্র কই মাছের জাত উন্নয়নে আরও গবেষণা চলছে বলে জানান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এইচ এম কোহিনুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে সাফল্য পাওয়া গেছে। মিশ্র কই মাছের জাত উন্নয়নের আরও গবেষণা চলছে, যেন এর রং, আকার ও স্বাদ দেশি কই মাছের মতো হয়। এরপরই পোনা উৎপাদন করা হবে। কারণ, চাষিরা আগ্রহ না হারান।

তবে দেশি কই মাছ যাতে হারিয়ে না যায়, এ জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হবে বলে জানান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পাবনা, গোপালগঞ্জ, রাজশাহীর মতো বিল অঞ্চলে দেশি কইয়ের পোনা ছাড়া হবে এবারের বর্ষাকালে। এ ছাড়া সারা বছর পানি থাকে—এমন জলাশয়ে কইয়ের পোনা ছাড়া হবে। সব মিলিয়ে ১০ হাজার কইয়ের পোনা ছাড়া হতে পারে। এর লক্ষ্য কই মাছের অভয়াশ্রম গড়ে প্রকৃতিতে মজুত বৃদ্ধি করা।