Thank you for trying Sticky AMP!!

পানচাষিদের স্বপ্ন ডুবেছে অপরিকল্পিত পুকুরে

অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে শতাধিক পানচাষির প্রায় ২০ হেক্টর জমির পানের বরজ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকা।

আবদুল কুদ্দুসের নিজের কোনো আবাদি জমি নেই। আট হাজার টাকায় একখণ্ড জমি ইজারা নিয়ে পানের বরজ করেছিলেন। এটিই তাঁর পরিবারের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল। এলাকায় অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় সেই বরজের সব পানগাছ মরে যায়। ইজারাদারের টাকা আর সংসারের অনটনের দায় এড়াতে আবদুল কুদ্দুস বিষপানে আত্মহত্যা করেন। আড়াই মাস আগে দুর্গাপুরের পানানগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

শুধু আবদুল কুদ্দুস নন, দুর্গাপুরের শতাধিক পানচাষির এবার সর্বনাশ হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতার হাত থেকে বাঁচতে তাঁরা ইউএনওর কাছে একাধিক আবেদন করেছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সব পানের বরজ বাঁচানো যায়নি। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক কোটি টাকা। তবে কৃষকেরা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।

দুর্গাপুরে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়। চাষির সংখ্যা ৩ হাজার ৭৪০। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, প্রায় ২০ হেক্টর জমির পানের বরজ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।

পানানগর গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের ছেলে মো. রিফাত জানান, তাঁদের বসতভিটা ছাড়া আর কোনো আবাদি জমি নেই। তাঁদের এলাকায় পান একটি লাভজনক ফসল। তাই তাঁদের বাবা বার্ষিক আট হাজার টাকায় একখণ্ড জমি ইজারা নিয়ে পানের বরজ করেছিলেন। বরজ থেকেই সংসার খরচ উঠে আসত। এবার পানি উঠে সব পানগাছ মরে যায়। এ নিয়ে বাবা খুবই চিন্তিত ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।

১৫ কাঠা জমিতে পানের বরজ ছিল। একটি গাছও বেঁচে নেই। জলাবদ্ধতার কারণে সব পানগাছ মারা গেছে। বরজে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। সর্বনাশ হয়ে গেছে।
পালশা গ্রামের মজিবুর রহমান

দুর্গাপুর থানার ওসি খুরশীদা বানু বলেন, তিনিও বিষয়টি শুনেছেন। তবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আবদুল কুদ্দুসের মৃত্যু হওয়ার কারণে তাঁদের থানায় রেকর্ড রাখা হয়নি।

উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের আলিয়াবাদ গ্রামের পানচাষি উজ্জ্বলের পানের বরজে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বরজের সব পানগাছ মারা গেছে। শুধু সারি সারি কাঠি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

পালশা গ্রামের মজিবুর রহমানের ১৫ কাঠা জমিতে পানের বরজ ছিল। তাঁর একটি গাছও বেঁচে নেই। জলাবদ্ধতার কারণে সব পানগাছ মারা গেছে। তিনি বলেন, বরজে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এক বিঘা আয়তনের একটি বরজ ভালো হলে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় হয়। পানিতে তাঁর এলাকার সব মানুষের সর্বনাশ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, একটি পুকুরের পাড় একটু ভালো করে কেটে দিলেই তাঁদের মাঠের সব পানি নেমে যাবে। পানি না নামাতে পারলে শুধু পান নয়, এবার মাঠে কোনো সবজিই হবে না।

অভিযোগ সঠিক নয়। নদীতেই পানি বেশি হওয়ার কারণে বিলের পানি নামতে পারেনি।
৩০০ বিঘা পুকুরের মালিক আবদুল হালিম

উপজেলার পুরান তাহেরপুর গ্রামের আকরাম হোসেনের প্রায় দুই বিঘা আয়তনের একটি পানের বরজ রয়েছে। পানি উঠে তাঁরও সব গাছ মারা গেছে। আকরাম বলেন, এই বরজই তাঁর পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। বছরে বরজ থেকে কম করে হলেও পাঁচ-সাত লাখ টাকায় আয় হতো। এখন অসুস্থ বাবার ওষুধ কেনার টাকাই জোগাড় করতে পারছেন না। তিনি বলেন, নির্বিচারে পুকুর খননের কারণে পানি নিষ্কাশনের সব প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

একই অবস্থা হয়েছে গ্রামের মুনসের আলী, আছির আলী ও জুয়েল আলীর বরজের। সবার বরজে শুধু কাঠিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আছির আলী বলেন, জলাবদ্ধতা তাঁর সব শেষ করে দিয়ে গেছে। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। নোনামাঠিয়াল গ্রামের গোলাম মোস্তফার প্রায় আড়াই বিঘার বরজের একই পরিণতি হয়েছে।

যখনই কৃষকদের অভিযোগ পেয়েছি, তখনই অভিযান চালিয়ে পুকুরের পাড় কেটে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যেসব সেতুর মুখ বন্ধ করে পুকুর বানানো হয়েছিল, সেগুলোর পাড় কেটে দেওয়া হয়েছে। তারপরও পুকুর হয়ে গেছে অসংখ্য।
মহসীন মৃধা, ইউএনও, দুর্গাপুর

চাষিদের অভিযোগ, জয়নগর, চুলকানির বিল, আনোলিয়ার বিল, নোনামাঠিয়াল ও বাগমারার বিল এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী পুকুরমালিক আবদুল হালিম, নান্টুসহ আরও কয়েকজন। পানানগর, ধরমপুর ও তেবিলার বিল এলাকার জলাবদ্ধতার জন্য পুকুরমালিক আবু হানিফ এবং উপজেলার নওপাড়া ও আংরার বিল এলাকার জলাবদ্ধতার জন্য আবদুর রহিম ও মিলনের পুকুরের ভূমিকাই বেশি। এ ছাড়া তাঁদের সঙ্গে রয়েছে আরও ছোট ছোট পুকুরের মালিকেরা। প্রাকৃতিকভাবে পানি নিষ্কাশনের পথে তাঁরা মাছ চাষের জন্য অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করেছেন। পুকুরের পাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এলাকায় বর্ষার পানি আর নামছে না।

তবে ৩০০ বিঘা পুকুরের মালিক আবদুল হালিম দাবি করেন, অভিযোগ সঠিক নয়। নদীতেই পানি বেশি হওয়ার কারণে বিলের পানি নামতে পারেনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় খনন বন্ধে অভিযান চালানো হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, পুকুর খননে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করে বাধার মুখেও পড়েছিলেন পুকুরমালিক আবদুর রহিম। তিনি সম্প্রতি হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন।

দুর্গাপুরের ইউএনও মহসীন মৃধা বলেন, যখনই কৃষকদের অভিযোগ পেয়েছেন, তখনই অভিযান চালিয়ে পুকুরের পাড় কেটে দিয়েছেন। বিশেষ করে যেসব সেতুর মুখ বন্ধ করে পুকুর বানানো হয়েছিল, সেগুলোর পাড় কেটে দিয়েছেন। তারপরও পুকুর হয়ে গেছে অসংখ্য।