Thank you for trying Sticky AMP!!

পুলিশি বাধায় শ্রদ্ধা জানানো হলো না স্বজনদের

রানা প্লাজা ধসের ৪ বছর

রানা প্লাজা ধসে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে গতকাল সোমবার পুলিশি বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন তাঁদের স্বজনেরা। পুলিশ তাঁদের রানা প্লাজা ধসে পড়ার স্থানটিতে দাঁড়াতে দেয়নি। পুলিশের বাধার মুখে পূর্বঘোষিত অনেক কর্মসূচিও পালন করতে পারেনি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। তবে জুরাইন কবরস্থানে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নিহতদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।

সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ার স্থানটির আশপাশেগতকাল ভোর চারটা থেকে অবস্থান নেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে  পুলিশ এবং সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থেকে আসা পুলিশের সদস্যরা। সেখানে জলকামান রাখা ছিল।

রানা প্লাজা ধসের চার বছরপূর্তিতে গতকাল ভোর থেকে সাভারে আসতেশুরু করেন দুর্ঘটনায় হতাহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ভবন ধসের স্থানে নির্মিত বেদির আশপাশে তাঁদের কাউকে দাঁড়াতে দেয়নি পুলিশ। পুলিশ কিছুক্ষণ পরপর বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে সেখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল।

পুলিশের এমন আচরণে বিস্মিত হয়েছেন সবাই। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দিনভর বৃষ্টির কারণে গতকাল স্বজনদের উপস্থিতি ছিল এমনিতেই কম। কষ্ট করে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও স্বস্তি না পেয়ে মর্মাহত হয়েছেন।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে পুলিশের এমন আচরণ পেয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, অনেক শ্রমিক এখানে এসেছিলেন রানা প্লাজা ধসের শিকার সহকর্মী শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানাতে। তাঁরা নিজেদের দাবিদাওয়াও নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কারণে তাঁরা শ্রদ্ধা জানানোর মতো পরিবেশটুকু পাননি। এমন আচরণ অত্যন্ত ন্যক্কারজনক।

এদিকে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে সাভার রানা প্লাজা সারভাইভার অ্যাসোসিয়েশন ও গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র মিছিল নিয়ে ফুল দিতে এলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের মানববন্ধন, সমাবেশসহ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি থাকলেও পুলিশ তা করতে দেয়নি। গতকাল গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের সমাবেশে পুলিশি বাধা ও হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এদিকে শ্রমিকদের মিছিলে পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।

নিরাপত্তা পরিস্থিতির বাড়াবাড়ি নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। ঘটনাস্থলে সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান বলেন, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা যাতে না হয়, সে কারণেই জলকামানসহ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। মিছিল বা সমাবেশে বাধা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের বাধার কারণে নয়, বৃষ্টির কারণেই তাঁরা মিছিল বা সমাবেশ করতে পারেননি।

একই থানার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, পাশের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যান চলাচল যাতে নির্বিঘ্ন হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই তাঁরা কাউকে জড়ো হতে দেননি। জলকামানের বিষয়ে তিনি বলেন, সাভার বাসস্ট্যান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এখানে সব সময়ই জলকামান থাকে।

রানা প্লাজা ভবনটি যেখানে ছিল সেখানে এখন আর কিছুই নেই। ধ্বংসস্তূপ সরানোর পর জায়গাটি নিচু হয়ে যাওয়ায় সেখানে পানি জমেছে। আর পুরো জায়গাটুকু ভরে আছে কচুরিপানায়। সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশের এই জায়গাটির সামনেই গতকাল সোমবার ভোর থেকে ছিল মানুষের আনাগোনা। তাঁদের কারও স্বামী ভবনের নিচে পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে মারা গিয়েছিলেন, কেউ হারিয়েছিলেন ভাই আর কেউবা বোনকে। অশ্রুসিক্ত হয়ে তাঁরা স্মরণ করেছেন স্বজনদের।

পুলিশের বাধার কারণে ঘটনাস্থলে দাঁড়াতে না পারলেও পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন রুবি বেগম। ছোট্ট মেয়ে সারিকা তাঁর কাপড় ধরে টানছিল আর এক নাগাড়ে জিজ্ঞেস করছিল ‘বাবা কোথায়’? রুবি ছিলেন নিশ্চুপ।

মেয়ের প্রশ্নের উত্তর জানা নেই রুবি বেগমের। কারণ, রানা প্লাজা ধসে সারিকার বাবা সাইফুর রহমান চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। রুবি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী সাইফুর রহমান মারা যাওয়ার পর তিনি সহায়তার যে টাকা পেয়েছিলেন, তার একটা বড় অংশই নিয়ে নিয়েছেন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। তিনি এখন কাপড় সেলাই করে যা আয় করেন, তাই দিয়ে সংসার চালান।

রানা প্লাজা ভবনের চারতলার একটি কারখানায় মাত্র এক সপ্তাহ আগে কাজ নিয়েছিলেন মো. লিটন। ভবনটি ধসে পড়লে তাঁর লাশটিও পায়নি তাঁর পরিবার। লিটনের মা নাসিমা বেগম, বোন রানী বেগম আর দাদি সাহাতন বেগম এসেছিলেন গতকাল। তিনজনের উচ্চ স্বরে কান্না উপস্থিত সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়।

জুরাইন কবরস্থানে শ্রদ্ধা

এদিকে গতকাল জুরাইন কবরস্থানেও জড়ো হয়েছিলেন এ ঘটনায় নিহত হওয়ার পর লাশ না পাওয়া অনেক স্বজন। এই কবরস্থানে রানা প্লাজা ধসের পর ২৯১ জনের লাশ কবর দেওয়া হয়, যাঁদের পরিচয় তখন পাওয়া যায়নি। পরে ১৫৭টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে।

সকাল থেকে বেলা একটা পর্যন্ত জুরাইন কবরস্থানে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। সকালে বৃষ্টির মধ্যে ফুল ও ব্যানার নিয়ে কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিহত ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। তাঁরা এই দুর্ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা-কর্মীরা নিহত ব্যক্তিদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ২৪ এপ্রিলকে গার্মেন্টস শ্রমিক শোক দিবস ঘোষণা করার দাবি জানান তাঁরা। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) যুগ্ম সমন্বয়ক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা আর যেন রানা প্লাজার মতো কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।’

দুপুর ১২টায় শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ফ্যাক্টরি মালিকদের কোনো অপরাধ নেই। এর জন্য দায়ী ভবনের মালিক সোহেল রানা। যাঁরা ভবনের বাড়তি অংশ তৈরি করতে অনুমোদন দিয়েছেন, তাঁদের শাস্তি দ্রুত হওয়া উচিত।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন হাজারো শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে অনেকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন। গত শনিবার বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইডের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, এই দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৪২ শতাংশ এখন বেকার।