Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রতিবন্ধী শিশুদের আলোকিত করছেন এক কৃষক

এই মহৎ মানুষটির নাম আবদুর রশিদ। তিনি একজন মধ্যবিত্ত কৃষক। লালমনিরহাট জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ দলগ্রামের পরশুরাম এলাকা। এখানেই ২০১২ সালের প্রথম দিকে কালীগঞ্জ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। রশিদের ছয় ভাই তাঁর এই মহতী কাজে সহায়তা করে যাচ্ছেন। মাত্র ৩৫ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। এখন ২৩৫ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এখানে ১০ জন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক ও তাঁদের ৪ জন সহকারী আছেন। ২০১৬ সালে এই বিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়। ওই সালে পাস করে চারজন। ২০১৭ সালে চারজন পরীক্ষা দিয়ে চারজনই উত্তীর্ণ হয়। ২০১৮ সালে চারজন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এদের মধ্যে দুজন পাস করে। এবার পঞ্চম শ্রেণিতে আটজন শিক্ষার্থী আছে।

জানা গেছে, ২০১২ সালে ৩০ হাত লম্বা ৩ কক্ষের টিনের দোচালা ঘরে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ২০১৭ সালের শেষ দিকে লালমনিরহাট জেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় এখানে আরও একটি ৩০ হাত লম্বা ৩ কক্ষের দোচালা টিনের ঘর নির্মাণ করা হয়।

১৪ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধী শিক্ষাসহায়ক উপকরণ দিয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন আবদুর রশিদ। তাঁকে সহায়তা করছিলেন আইরিন বেগম। অপর একটি শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ইশারায় বাংলা বর্ণমালা ও সংখ্যা শিক্ষা উপকরণ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক আবদুল হাকিম।

ওই দিন বিদ্যালয়ে ৪৫ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। কথা হয় অভিভাবক সুন্দ্রাহবি গ্রামের রেহেনা বেগম, কুড়িখাতা গ্রামের ফজিলা বেগম, তুষভান্ডারের আমিনা বেগম ও মৌজা শাখাতী গ্রামের নার্গিস আক্তারের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, বাড়ির কাছের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁদের সন্তানদের ভর্তিতে উৎসাহ দেখায় না। এ অবস্থায় আবদুর রশিদের কালীগঞ্জ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন।

দর্শনে স্নাতকোত্তর করেছেন কালীগঞ্জের মদাতী ইউনিয়নের মৌজা শাখাতীর বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম। তিনি শুরু থেকে এখানে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম প্রথম অভিজ্ঞতা না থাকায় কাজ করতে সমস্যা হতো। পরে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রশিদ এবং তাঁর ছোট ভাই হারুন-অর-রশীদের দায়িত্ববোধ দেখে ভালোবেসে ফেলেছি।’

প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প শোনালেন প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তাকে ভর্তি নিতে চাচ্ছিল না। আশপাশের গ্রামের প্রতিবন্ধী শিশুদেরও বিদ্যালয়ে ভর্তি নেওয়া হচ্ছিল না। শুধু প্রতিবন্ধী হওয়ার জন্য ওরা পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে না, এটা দেখে আমার খুব কষ্ট লাগে। তাই ওদের লেখাপড়া করানোর জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকি। এরপর ভাই এবং এলাকার মানুষের সহায়তায় গড়ে তুলি বিদ্যালয়।’

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য জানাতে গিয়ে আবদুর রশিদ বলেন, ‘সবাই মনে করে প্রতিবন্ধী শিশুরা লেখাপড়া না শিখে পরিবার ও সমাজের বোঝা হচ্ছে। এই মনোভাব পরিবর্তনের জন্য আমি ও আমার এক ভাই জমি দিয়ে বিদ্যালয় করলাম। প্রতিবন্ধী শিশুদের আরও সুন্দরভাবে সেবা ও সহায়তা করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা সংস্থা সেন্টার ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) থেকে ২০১৪ সালে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এই বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।’

আবদুর রশিদের মা রশিদা বেগম বলেন, ‘আমার ছয় ছেলেই প্রতিবন্ধীদের ভালোবাসে। তাদের মধ্যে রশিদের টানটা একটু বেশি। রশিদ জমির কাজ করে যতটুকু সময় পায়, তার সবটাই প্রতিবন্ধীদের সেবায় দেয়। রশিদ তার নিজের মেয়েদের চেয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের বেশি ভালোবাসে। তাদের গোসল করায়, কাপড় পরায় ও কান্নাকাটি করলে গল্প শোনায়।’

লালমনিরহাট মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রদর্শক ও রশিদের ছোট ভাই হারুন-অর-রশীদ বলেন, ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে আনা-নেওয়ার করার জন্য ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে দুটি ইজিবাইক কেনা হয়। ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে সেগুলো চালানো যাচ্ছে না। এ কারণে দূরের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না।

দলগ্রাম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সফিয়ার রহমান সাফি বলেন, আবদুর রশিদ ও হারুন-অর-রশীদের নিজের জমিতে গড়ে তোলা কালীগঞ্জ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি শুধু এই ইউনিয়ন নয়, আশপাশের ৩০টি গ্রামের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার আশার আলো জ্বেলেছে। তবে শিক্ষকদের চাকরি সরকারি অনুমোদন পেলে পড়ালেখার মান আরও উন্নত হতো।

লালমনিরহাট সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, বিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। প্রণয়ন শেষে তা অনুমোদিত হলে ওই বিদ্যালয়ের উন্নয়নে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রবিউল ইসলাম বলেন, কালীগঞ্জ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য যে ভূমিকা রেখে চলেছে, তা এককথায় অনুকরণীয় এবং প্রশংসার যোগ্য।