Thank you for trying Sticky AMP!!

বঙ্গবন্ধুর চিঠি হাতে নিয়ে এখনো কাঁদেন আছিয়া

আছিয়া খাতুন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আছিয়া খাতুনের (৭৫) ঘর পুড়েছে শত্রুর দেওয়া আগুনে। বেয়নেটের খোঁচায় নিহত ভাই আর স্বামীর লাশ মাটিচাপা দিয়েছেন নিজ হাতে। কারও ফিরে আসার অপেক্ষা নেই তাঁর। অপেক্ষা কেবল প্রিয়জনদের জীবনের দামে পাওয়া স্বাধীন দেশের সুসময়ের।

আছিয়ার দুচোখে ছানি পড়েছে। কঙ্কালসার দেহ নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। দরিদ্রতা আর অবহেলায় পার করছেন দুঃস্বপ্নের এক জীবন। মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে এক বছর বয়সী ছোট ছেলেকে দত্তক দিয়েছিলেন ৪৭ বছর আগে। ক্যানসারে আক্রান্ত বড় ছেলে আলী আহমেদ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে দুই বছর আগে। তাঁর আপন বলতে এখন প্রতিবন্ধী মেয়ে আনোয়ারা, আর আলী আহমেদের তিন সন্তান এবং তাঁর স্ত্রী। তিনি এখন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলী এলাকায় ভাইয়ের ভিটায় আশ্রিতা। তাঁদের খাবার জোটে ১২ বছরের নাতি তুহিনের রিকশা চালানোর টাকায়।

সম্প্রতি কথা হয় আছিয়ার সঙ্গে। আছিয়ার ছোট্ট উঠানের পাশে ছোট্ট ভাঙা দোচালা ঘর। কাঠগুলো ঘুনে খেয়েছে। ভেঙে গেছে টিন। জানালা নেই। ঘরজুড়ে অন্ধকার। বৃদ্ধা আছিয়ার মতোই যেন দুর্বল আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে কোনোমতে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে ঘরটি। বাড়িতে অপরিচিত কেউ এসেছে শুনেই দুর্বল পায়ে এগিয়ে আসেন বৃদ্ধা।

কথা শুরুর আগেই বিলাপ শুরু করেন আছিয়া। এ প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন, ‘স্বাধীনের কত বছর অইল? এত বছর পর কেন আইছ? আমার সময়তো শেষ, এই কষ্টের দিন কি শেষ অইব না?’ তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর বক্তাবলী গণহত্যায় ১৩৯ জনকে হত্যা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। গানপাউডার ছিটিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পুরো গ্রাম। অনেকের সঙ্গে সেদিন আছিয়ার স্বামী আবদুল খালেক ও ভাই হাবিবুর রহমানকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারেরা। সেদিনই ভাইয়ের লাশ পেয়েছিলেন ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে। চার দিন পর ধলেশ্বরীতেই ভেসে উঠেছিল স্বামীর লাশ। সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করেন আর কাঁদেন আছিয়া। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদেন তাঁর মেয়ে আনোয়ারা। বাবার মৃত্যুর সময় সাত বছর বয়স। তবুও স্পষ্ট বলতে পারেন, বাবার লাশটা চেনার উপায় ছিল না। শরীরজুড়ে ছিল বেয়নেটের ক্ষত।

স্বাধীন দেশে তিন সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু আছিয়ার। সাত বছরের আনোয়ারা, তিন বছরের আলী আহমেদ আর এক বছর বয়সী ছোট ছেলে। এতিম ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার তুলে দিতে একটি মাদ্রাসায় আয়ার কাজ নেন। ১০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। ছোট্ট শিশুকে নিয়ে মাদ্রাসায় যেতে মানা। দুধ কেনার পয়সা নেই। বাধ্য হয়েই কোলের শিশুকে দত্তক দেন। আরেক সন্তান আলী আহমেদ ক্যানসারে ভুগে দুই বছর আগে বিনা চিকিৎসায় মারা যান।

আজও দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে বক্তাবলীর শহীদ পরিবারগুলো। তবে গত ৪৯ বছরেও এই গণহত্যার শহীদদের স্বীকৃতি মেলেনি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া কেউ খোঁজ নেননি আছিয়ার। সে বছর পরিবারপ্রতি দুই হাজার টাকাসহ শহীদ পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বামী আর ভাইয়ের স্মৃতি হিসেবে সেই চিঠি আজও আগলে রেখেছেন বৃদ্ধা।

হঠাৎ প্রশ্ন করেন। ‘উনি (বঙ্গবন্ধু) কইয়া গেলেন, এই মরণ গৌরবের। কই, আমার তো গৌরব নাই। আর কত অপমানের পর গৌরব পামু? এই দিন কি শেষ অইব না?’ একপর্যায়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। চোখ মোছেন। আদরে–ভালোবাসায় চিঠিতে হাত বোলান আছিয়া।

শহীদ পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দিয়ে সে চিঠিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, ‘এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের পিতা/পুত্র/স্বামী/স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন।’