Thank you for trying Sticky AMP!!

পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি সংযোগ করার কাজ শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মাওয়া প্রান্তে

বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু

পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত গেছে এই সেতুর অবকাঠামো। সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্বে এটি এক অনন্য সংযোজন। এ রকম আরও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে এই সেতু বিশ্বজুড়ে প্রকৌশলবিদ্যার পাঠ্যবইয়ে ঠাঁই করে নেবে বলে মনে করছেন প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা।

প্রকৌশলীরা বলছেন, বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ। যে কারণে পানির গভীরে শক্ত মাটি পাওয়া যায় না। এর ফলে পাইল গভীর করতে হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খান মাহমুদ আমানত প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুর মতো সেতু দুনিয়ার কোথাও নেই বলা যায়। কারণ, এর কারিগরি চ্যালেঞ্জগুলো অন্য কোনো সেতুতে ছিল না। পদ্মা সেতুর পাইল বিশ্বে গভীরতম। এই কাজ ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু যখন হয়, তখন সেটির পাইলও ছিল বিশ্বে গভীরতম। এখন পদ্মা সেতু বিশ্বে গভীরতম ভিত্তির সেতু বলা যেতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে পদ্মা সেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকৌশলবিদ্যার পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বর্তমানে এক্সপ্রেসওয়েকেও সেতু হিসেবে গণ্য করা হয়। সে কারণেই বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর তালিকা করা এখন অনেকটা কঠিন। তবে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে নির্মিত দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু হতে চলেছে পদ্মা সেতু। ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশ ও নেপালের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি।

চলছে স্প্যান সংযোগ করার কর্মকাণ্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মাওয়া প্রান্তে

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে দীর্ঘতম সেতুটি হলো ভারতের আসামের ভূপেন হাজারিকা সেতু। ব্রহ্মপুত্রের শাখা লোহিত নদীর ওপর নির্মিত ৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের সঙ্গে অরুণাচলকে যুক্ত করেছে।

ভারতে গঙ্গা নামে পরিচিত আর বাংলাদেশে পদ্মা নাম ধারণ করা নদীর ওপর নির্মিত এই সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এত দিন পদ্মা-গঙ্গার ওপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু ছিল ভারতের বিহারের মহাত্মা গান্ধী সেতু। ৫ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কসেতুটি বিহারের পাটনার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলীয় হাজিপুরকে যুক্ত করেছে। তবে পদ্মা সেতু গঙ্গা-পদ্মার ওপর দীর্ঘতম সেতুর তকমা খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, বিহারেই গঙ্গার ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে ৯ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কাচ্চি দরগা-বিদুপুর সেতু। ২০২১ সালের নভেম্বরে ছয় লেনের সড়কসেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

পদ্মা সেতুর বিশেষত্ব হলো, এটি দ্বিতল। নিচের অংশে ছুটবে ট্রেন, ওপর দিয়ে চলবে গাড়ি। বঙ্গবন্ধু সেতুও সড়ক ও রেলসেতু। তবে এই সেতুতে সড়কপথের পাশ দিয়েই চলে গেছে রেললাইন। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু ১৯৯৮ সালের জুনে উদ্বোধন করা হয়।

বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হলো চীনের ‘দানিয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ’। বিবিসি, সিএনএন ও চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিনহুয়ার তথ্যানুসারে, ১৬৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রেলসেতু চীনের সাংহাইয়ের সঙ্গে জিয়াংশু প্রদেশের নানজিং এলাকাকে যুক্ত করেছে। এর কিছু অংশ গেছে পানির ওপর দিয়ে, বাকিটা স্থলভাগের ওপর। ১০ হাজার কর্মীর নিরলস প্রচেষ্টায় মাত্র চার বছরে সেতুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ২০১০ সালে নির্মাণ শেষ হওয়ার পর ২০১১ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ এই সেতুকে যেকোনো ক্যাটাগরিতে (শ্রেণিতে) বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের উচ্চগতির ট্রেন চলাচল করে দানিয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজের ওপর দিয়ে।

প্রকৌশলীরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়ে আর সেতু—একই জিনিস, তা স্থলভাগের ওপর দিয়েই যাক কিংবা জলভাগের ওপর দিয়ে। সে হিসেবে চীনের দানিয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু। তবে সড়ক ও রেল—দুটো একসঙ্গে চিন্তা করলে পদ্মা সেতু দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বিশ্বের সেতুগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবে। তবে প্রথম ১০টির মধ্যে থাকবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সিএনএনের তথ্যমতে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতুটিও রেলসেতু। ১৫৭ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের এই সেতু তাইওয়ানে। এর ওপর দিয়েও উচ্চগতির ট্রেন ছুটে চলে।

আর সড়কপথে বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর মুকুট থাইল্যান্ডের বাঙনা এক্সপ্রেসওয়ের। নামেই বোঝা যায়, এটি ঠিক সেতু নয়। মহাসড়কের ওপর আরেক মহাসড়ক। ছয় লেনের ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় ২০০০ সালে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এটি বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু ছিল। বর্তমানে এটি যেকোনো ক্যাটাগরিতে বিশ্বের সপ্তম দীর্ঘতম সেতু।

সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম স্ট্রেইটস টাইমস এবং গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পানির ওপর নির্মিত বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হলো হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাউ সেতু। ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু উদ্বোধন করা হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তবে সেতুটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। সাগরতলে টানেলও রয়েছে এর অংশ হিসেবে। তাই এ সেতুর নামের পাশে ‘সামষ্টিক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাউ সেতুর আগে পানির ওপর বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু ছিল যুক্তরাষ্ট্রের লুজিয়ানার লেক পঞ্চারট্রেইন কজওয়ে। দুটি পাশাপাশি সেতুর সমন্বয়ে গঠিত এই সেতুর দৈর্ঘ্য ৩৮ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। তবে হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাউ সেতু এবং লেক পঞ্চারট্রেইন কজওয়ে—দুটি সেতুই সড়কসেতু।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সড়ক ও রেল যোগাযোগ—উভয় মিলে বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হলো চীনের উহু ইয়াংশি রিভার ব্রিজ। সাড়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু ইয়াংশি নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০০ সালে। গিনেস বুকেও বিশ্বের দীর্ঘতম সড়ক ও রেলপথ সেতু হিসেবে এই সেতুর নাম রয়েছে। অন্যান্য ক্যাটাগরির সেতুর তুলনায় বিশ্বে এই ধরনের সেতুর সংখ্যা কম। সেদিক থেকে পদ্মা সেতু এই ক্যাটাগরিতে সামনের সারিতেই থাকবে।

বুয়েটের অধ্যাপক খান মাহমুদ আমানত প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু যখন তৈরি হয়, তখন বিশ্বে বিশাল সব সেতু তৈরির হিড়িক পড়েনি। গত ১০ বছরে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক উন্নয়নকাজ হয়েছে। চীনসহ বিভিন্ন দেশে বড় বড় অনেক সেতু হয়েছে। চীন সমুদ্রের ওপর এত বড় বড় সেতু তৈরি করেছে যে এখন পাঁচ, ছয় কিংবা সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু অনেকটা সাধারণ হয়ে গেছে।