Thank you for trying Sticky AMP!!

বুনো কলাগাছে ‘প্রাণ’ পেল পানির উৎস

দুটি পাড়ার পানির কষ্ট অনেকটাই দূর হয়েছে। এখানে বাস করে ৫৯টি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার।

পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট অনেক পুরোনো। শুষ্ক মৌসুমে অবস্থা হয় ভয়াবহ। এ সময় পানির উৎস ঝিরি-ঝরনাগুলো শুকিয়ে যায়। তখন পাড়ায় পাড়ায় পানির জন্য হাহাকার চলে। দিন দিন এই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে। তবে প্রাকৃতিকভাবেই এর সমাধান খুঁজে বের করেছেন বান্দরবানের দুটি পাড়ার বাসিন্দারা। বুনো কলাগাছের মাধ্যমে পানির উৎসগুলো আবার ‘জীবন্ত’ করে তুলেছেন তাঁরা।

বান্দরবানের শহরতলির দাঁতভাঙ্গা পাড়া ও ডলুঝিরি পাড়ার বাসিন্দাদের পানির দুঃখ দূর করেছে বুনো কলাগাছ। এই দুটি পাড়ায় ৫৯টি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার রয়েছে। তাঁরা এখন কলাগাছের পাশাপাশি ঝিরি-ঝরনায় আর্দ্রতা ধারণে সক্ষম দেশি গাছের চারা লাগাচ্ছেন।

পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে পাহাড় চূড়ায় পাড়া দুটিতে বসবাস শুরু হয়। পাড়াবাসীদের পানির উৎস হচ্ছে ঝিরি-ঝরনা। এগুলোর উৎপত্তিস্থলও পাহাড়চূড়া থেকে। কিন্তু নির্বিচার বন নিধন ও পাথর উত্তোলনের কারণে ঝিরি-ঝরনাগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। পানির সংকটে পাড়া থেকে বসতি সরিয়ে নেওয়ার উপক্রম হয়।

বান্দরবান সদর ইউনিয়নের সাবেক সদস্য ও দাঁতভাঙ্গা পাড়াবাসী লবক তঞ্চঙ্গ্যা পানিসংকটের সমাধান খুঁজে পাওয়ার গল্প শোনালেন প্রথম আলোকে। সম্প্রতি তিনি বলেন, পানির সংকটে পাড়া টিকিয়ে রাখার উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন কয়েক বছর আগে চোখ পড়ে একটি পাড়ার পাশে একটি ঝিরির উৎপত্তিস্থলে। দেখতে পান প্রচুর পানি আছে ঝিরিতে। এই উৎপত্তিস্থলের চারপাশে ছিল বেশ কিছু বুনো কলাগাছ। এমনকি শুষ্ক মৌসুমেও সেখানে পানি থাকে। পাড়াবাসী এখান থেকে শিক্ষা নেন। পাড়ার সাতটি পানির উৎসে বুনো কলাগাছ রোপণ করতে শুরু করেন। একই সঙ্গে ঝিরি-ঝরনার দুই পাশে প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করতে থাকেন। পাশাপাশি দেশি গাছের চারা লাগাতে থাকেন। এর ফল পেতে শুরু করেন। এসব পদক্ষেপের ফলে প্রায় মরে যাওয়া ঝিরি-ঝরনাগুলো জীবন্ত হতে শুরু করে। এখন পানির সমস্যা অনেকটাই দূর হয়েছে। দাঁতভাঙ্গা পাড়াবাসীর দেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে পানির কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছেন পাশের ডলুঝিরি পাড়াবাসীরাও।

পাড়ার নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারকে চারা লাগানোর কাজে অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক বলে জানান পাড়াবাসী পবন তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি বলেন, এভাবে কয়েক বছর ধরে কলাবনের পাশাপাশি সম্মিলিতভাবে প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ ও গাছের চারা লাগাচ্ছেন। কিছু চারা মরে যায়, সেখানে আবার লাগানো হয়।

সম্প্রতি জেলা শহরের মেঘলাসংলগ্ন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত দাঁতভাঙ্গা পাড়া ও ডলুঝিরি পাড়া সরেজমিনে দেখা যায়, দুটি পাড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই মনোরম। ফলদ-বনজ বাগানে ভরপুর এবং পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। প্রতিটি পানির উৎসে রয়েছে বেশ কটি বুনো কলাগাছে। কলাগাছগুলো কিছু বেড়ে উঠেছে প্রাকৃতিকভাবে ও কিছু পাড়াবাসীর লাগানো। পাশাপাশি সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে দেশি গাছ ও লতাগুল্ম রয়েছে। দুই পাড়াবাসী মিলে ঝিরি-ঝরনাগুলোর দুই তীরে লাগানোর জন্য গাছের চারা ভাগাভাগি করে থুরুংয়ে (বেতের ঝুড়ি) করে নিয়ে যাচ্ছেন।

কয়েক বছর ধরে পাড়াবাসীদের উৎসাহ দেখে তাড়ুম নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চারা সরবরাহ দিয়েছে। বান্দরবান সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীরও চারা বিতরণ করেছেন।

দাঁতভাঙ্গা পাড়ার কারবারি জয়ন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, নির্বিচার বন নিধন এবং ঝিরি-ঝরনার পাথর পাচারের কারণে পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। এখন পাড়াবাসী নিজেদের উদ্যোগে কলাবন ও গাছের চারা লাগাচ্ছেন। লটকন, ডুমুর, জারুল, জাম, কড়ই, গামারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি গাছ পানির উৎসের ছায়া দিয়ে আর্দ্রতা ধরে রাখে।

পাড়ার বাসিন্দা ও বান্দরবান সরকারি কলেজের স্নাতকের ছাত্রী সুমিতা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, কলাবাগানের মাধ্যমে উৎস পরিচর্যা করায় পানির সংকট এখন তেমনটা নেই। তবে সমস্যা একেবারে দূর হয়েছে তা নয়। মাঝেমধ্যে সংকট হয়। এতে নারীদের কষ্ট বাড়ে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বান্দরবানের মৃত্তিকা সংরক্ষণ ও পানি বিভাজিকা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, জংলি কলাগাছের বনও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের অংশ। প্রাকৃতিক বনের গাছ ও লতাগুল্মের সঙ্গে জংলি কলাগাছের বন থাকলে ঝিরি-ঝরনার পানি ধরে রাখা সহায়ক হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে শুধু কলাগাছে পানি ধরে রাখা যাবে না। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যেখানে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রয়েছে, সেখানে পানি আছে।