Thank you for trying Sticky AMP!!

ভৈরবে শিশুশ্রমের করুণ পরিণতি

অল্প বয়সে কাজ করতে গিয়ে ডান হাত হারিয়েছে শিশু নাঈম হাসান। সে বর্তমানে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন

নাঈম হাসানের বয়স ১০ বছর। পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামে। তার বাবা আনোয়ার হোসেনের পেশা জুতা ব্যবসা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর সময়ে আনোয়ার হোসেন কর্মহীন হয়ে পড়েন। এ সময় সংসারের চাপ সামলাতে নাঈমকে তার মা–বাবা কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি ওয়ার্কশপে কাজে দেন। এই ওয়ার্কশপের কাজ করতে গিয়েই মাসখানেক আগে তার ডান হাতটি মেশিনে ঢুকে যায়। শেষে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় ডান হাতটি।

নাঈম এখন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। এক মাসের বেশি সময় ধরে সে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়। এদিকে সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর হাসপাতালের বড় অঙ্কের বিল পরিশোধ নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটছে নাঈমের মা–বাবার।

জানা গেছে, নাঈমের বাবা আনোয়ার হোসেন কর্মসূত্রে এক বছরের বেশি সময় ধরে স্ত্রী মনোয়ারা বেগম ও তিন সন্তানকে নিয়ে ভৈরবে বাস করছেন। তিন সন্তানের মধ্যে নাঈম বড়। ভৈরব থেকে জুতা কিনে বিভিন্ন জেলা শহরে নিয়ে বিক্রির আয় দিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনাকাল শুরুর পর থেকে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের হাল ধরতে একপর্যায়ে আনোয়ার সবজির ব্যবসা শুরু করেন। এরই মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন আনোয়ার। এরপর আবার কর্মহীন হয়ে পড়েন তিনি। তাঁরা ভাড়া থাকতেন ভৈরবের কমলপুর এলাকার নূর বিল্ডিং নামের একটি ভবনে। একদিকে করোনার বাস্তবতা, অন্যদিকে বিছানায় পড়ে থেকে আনোয়ারের পক্ষে পরিবারের সবার খাওয়ার খরচ ও বাড়িভাড়া জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছিল না।

নাঈমদের পরিবার যে ভবনে ভাড়া থাকত, সেই ভবনের মালিক ওই এলাকার ইয়াকুব হোসেন (৫০) নামের এক ব্যক্তি। ওই এলাকাতেই ইয়াকুব হোসেনের নূর ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি ওয়ার্কশপ রয়েছে। বাড়ির ভাড়াটিয়া আনোয়ার হোসেনের পরিবারের দুরবস্থা দেখে নাঈমকে তাঁর ওয়ার্কশপের কাজে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি কথা দেন, নাঈমকে দিয়ে কোনো ভারী কাজ করাবেন না। শুধু চা আনা আর ঝাড়পোছের মতো হালকা কাজ করানোর প্রস্তাব দেওয়ায় রাজি হয়ে যান আনোয়ার-মনোয়ারা দম্পতি। প্রথম রমজানে কাজে যোগ দেয় নাঈম।

নাঈমের পরিবারের দাবি, শুরুর দুই মাস কথা রেখেছেন ইয়াকুব। নাঈমকে দিয়ে হালকা কাজই করানো হতো। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজের বিনিময়ে পেত দুই হাজার টাকা। দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগ থেকে নাঈমকে ড্রিল মেশিন চালানোর কাজে যোগ দিতে বলেন ইয়াকুব। রাজি না হওয়া তাকে মারধর করা হয়। পরে বাধ্য হয়ে নাঈম ড্রিল মেশিনের কাজে হাত লাগায়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে নাঈম দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ সময় ড্রিল দিয়ে মোটা পাইপ কাটার সময় ড্রিল মেশিনে তার ডান হাতটি ঢুকে যায়। শেষে শিশুটিকে বাঁচাতে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে ডান হাতটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।

নাঈমের মা–বাবা জানান, দুর্ঘটনার পর নাঈমকে প্রথমে নেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে তাকে ঢাকার রাজারবাগ এলাকার দ্য বারাকা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পরই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নাঈমের ডান হাতটি কেটে ফেলা হয়। এরপর থেকে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন আছে নাঈম। দুর্ঘটনার প্রথম দিকে চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর কথা বললেও এখন প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে এসেছেন ইয়াকুব।

নাঈমের মা মনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে ব্যথায় কাতরায়। এক সপ্তাহ পর তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। হাসপাতালে বিল হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মালিক দিয়েছেন ৫৫ হাজার টাকা। টাকা চাইলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, আর দিতে পারবেন না। এখন ফোনও ধরেন না।’

এই পরিস্থিতিতে নাঈমের চাচা শাহ পরান বাদী হয়ে জবরদস্তিমূলক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগিয়ে আহত করার অভিযোগে গত ১০ অক্টোবর ভৈরব থানায় মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় ওয়ার্কশপের মালিক ইয়াকুব হোসেন, ওয়ার্কশপের মিস্ত্রি স্বপন মিয়া, জুম্মান মিয়া, সোহাগ মিয়া ও ব্যবস্থাপক রাজু মিয়াকে।

দেরিতে মামলা করার কারণ জানতে চাইলে বাদী শাহ পরান বলেন, ‘আমরা চেয়েছি নাঈমের সুস্থতা। শুরুতে চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর প্রতিশ্রুতি ছিল মালিকের পক্ষ থেকে। কিন্তু মালিক এখন কেটে পড়েছেন। তাঁকে ধরা যাচ্ছে না। পাল্টা গালিগালাজ করছেন। এই অবস্থায় আইনের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গতি ছিল না।’

তবে নাঈমের পরিবার সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে ইয়াকুব হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নাঈমকে ওয়ার্কশপে কোনো রকম কাজে লাগাননি তিনি। তিনি দাবি করেন, ‘আমার বাসার সঙ্গে ওয়ার্কশপ। নাঈম চঞ্চল প্রকৃতির। প্রায়ই ওয়ার্কশপে এসে এটা-ওটা ধরত। আমরা বারণ করতাম। এলে মারও দিতাম। তারপরও থামানো যেত না। দুর্ঘটনার দিন বিকেলে আমরা নামাজ পড়তে গেলে নাঈম এসে ড্রিল মেশিনে হাত দেয়। তাতেই দুর্ঘটনা ঘটে।’

ভৈরব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলী মোহাম্মদ রাশেদ বলেন, ‘মামলা হওয়ার দিনই আমরা সোহাগ মিয়া নামের এক আসামিকে গ্রেপ্তার করি। অন্যরা গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তাঁদের ধরার চেষ্টা চলছে।’