Thank you for trying Sticky AMP!!

ময়নামতি-শালবনজুড়ে শূন্যতা, কাউন্টারে মাকড়সার বাসা

পাঁচ মাস ধরে বন্ধ শালবন বৌদ্ধ বিহার। ছবিটি গত ৩০ জুলাই তোলা। ছবি: এম সাদেক, কুমিল্লা

বছরজুড়ে ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কুমিল্লার শালবন বিহার এলাকা পর্যটকদের পদচারণে মুখর থাকত। নানা বয়সী দেশি-বিদেশি পর্যটক আর শিক্ষার্থীদের কোলাহলে প্রাণচাঞ্চল্যময় থাকত জেলা ব্রান্ডিং এলাকাটি। কর্মব্যস্ত থাকতেন পর্যটন ঘিরে সংশ্লিষ্ট খুদে ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরাও। পাঁচ মাস ধরে পর্যটনস্থানগুলোতে কোলাহল নেই। পর্যটকের পায়ের ধুলা পড়ে না সেখানে।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকার ঐতিহ্যবাহী লালমাই পাহাড় ঘিরে গড়ে ওঠা শালবন বিহারসহ সরকারি সৌন্দর্যমণ্ডিত নিদর্শন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পার্ক বন্ধ থাকায় পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। পর্যটকশূন্য হওয়ায় ঋণের বোঝা টানতেই ক্লান্ত পাহাড়ের বুকে স্থাপিত পার্কমালিকেরা। তাঁরা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন–ভাতাদি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। কোনো কোনো পার্ক ব্যয় কমাতে কর্মী ছাঁটাই করেছে। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। এ অবস্থায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এদিকে কুমিল্লা নগর শিশু উদ্যানের শিশুপার্ক, ঢুলিপাড়া এলাকার ফান টাউনসহ কয়েকটি পার্কে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বসে আছেন উদ্যোক্তারা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে টানা ১৪৪ দিন (৮ আগস্ট পর্যন্ত) কুমিল্লা জেলার পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ রয়েছে। এতে বেশির ভাগ কর্মী গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন। ১০ এপ্রিল থেকে কুমিল্লা জেলা লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা হয়। এরপর পর্যটন স্পটগুলো একেবারেই ফাঁকা হয়ে যায়। ব্যক্তিমালিকানাধীন পার্কগুলো তাদের বিভিন্ন রাইড ও নানা ধরনের স্থাপনা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কিছু কর্মীকে কাজে রেখেছেন। এঁদের বেশির ভাগকেই অর্ধেক বেতন দেওয়া হয়। অন্যরা বাড়ি গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
পর্যটক নেই, রাজস্বও নেই

কুমিল্লার লালমাই ও ময়নামতি পাহাড় এলাকায় অন্তত ২৩টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১২টি উন্মোচিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে শালবন বিহার, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, লতিকোট বিহার, আনন্দবিহার, ভোজবিহার, রানীর বাংলো, কোটালি মুড়া, চারপত্র মুড়া, হাতিগাড়া মুড়া, ময়নামতি মাউন্ট (ঢিবি) ১ ও ২।

এর মধ্যে শালবন বিহার ও এর লাগোয়া ময়নামতি জাদুঘর থেকে সরকার রাজস্ব আয় করছে। অন্যগুলো এখনো বিনা ফিতে দেখতে পারছেন ভ্রমণপিপাসুরা। করোনাভাইরাস মহামারির আগে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশি–বিদেশি ৮০ হাজার ৬২২ জন পর্যটকের কাছ থেকে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৫ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮০৬ জন পর্যটকের কাছ থেকে ২৬ লাখ ২৩ হাজার ২৮০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। মার্চ মাসের ১৬ দিনে ৯০ হাজার ৩৯০ জন পর্যটকের কাছ থেকে আদায় হয় ১১ লাখ ১৫ হাজার ৮১৫ টাকা। আড়াই মাসে রাজস্ব আয় মিলেছে ৫০ লাখ ৯৪ হাজার ৫৪০ টাকা। মহামারির কারণে গত চার মাস ২৪ দিনে কোনো রাজস্ব আয় নেই। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, কুমিল্লার শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর থেকে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮১৫ টাকা। গত এক বছরে এখানে দেশি দর্শনার্থী এসেছেন ৫ লাখ ৫৮ হাজার ২২২ জন ও বিদেশি ১ হাজার ৬৭ জন।

২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৯৯১ টাকা।
২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ টাকা।

কুমিল্লার ময়নামতি জাদুঘরের হেফাজতকারী মো. হাফিজুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে রাজস্ব আদায় স্থবির হয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।

পাঁচ বন্ধ ধরে বন্ধ কুমিল্লা ময়নামতি জাদুঘর। জনশূন্য বিহারের প্রধান ফটক। ছবিটি গত ৩০ জুলাই তোলা। ছবি: এম সাদেক, কুমিল্লা

সরেজমিনে শালবল–ময়নামতি
গতকাল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কোটবাড়ীর শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর এলাকা পরিদর্শন করা হয়। অনুমতি নিয়ে ভিআইপি ফটক দিয়ে জাদুঘর ক্যাম্পাসে ঢুকে চোখে পড়েছে নানা প্রজাতির ভেষজ গাছ। পুরো জাদুঘর ভবনের চারপাশজুড়ে সবুজের সমারোহ। জাদুঘরের ফটকে, প্রধান দরজায় তালা। বাগান পেরিয়ে শালবন বিহারে প্রবেশ করে দেখা গেছে ঘন সবুজে ঘেরা গাছগাছালি। ফুলের বাগানও সবুজময়।

কর্মীরা শালবন বৌদ্ধ বিহারের উন্মোচিত অংশের নানা দিক পরিছন্ন করছেন। শালবন বিহারে প্রবেশের টিকিট কাউন্টারে মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। ধুলায় ধূসর টিকিট কাউন্টার। শালবন বিহারের পাশেই খুদে ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ। কেবল সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির দোকানসহ তিনটি দোকান খোলা আছে। এখানে পর্যটকদের জন্য আনা বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও জিনিস রয়েছে।

খুদে ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে ৪০টির মতো দোকান আছে। এখন তিনটি খোলা। কিন্তু কোনো কাস্টমার নেই। পর্যটক নেই। এমনিই বসে আছি। আমার দোকানে দুই লাখ টাকার মালামাল আছে। শালবন বিহার চালু থাকলে ১৫ দিনেই এগুলো বিক্রি হতো। এখন বিক্রিও নেই। মালামালও নষ্ট হচ্ছে। ঋণ নিয়ে মাল ওঠানোর পর করোনার কারণে সরকার বিহার বন্ধ করে দেয়।’

কুমিল্লায় অবস্থিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক মো. আতাউর রহমান বলেন, করোনার প্রকোপের কারণে শালবন বিহার এলাকায় প্রাণচাঞ্চল্য নেই। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে পর্যটন খাতে ধস নেমেছে।

বড় বিনিয়োগে ধাক্কা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পেরিয়ে দক্ষিণে সালমানপুর এলাকার ৩৫ একর জায়গা নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে গড়ে উঠেছে ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরনের রাইড স্থাপন করে কম সময়ে পর্যটকদের নজর কেড়েছে এই পার্ক। শুরুতে নিজেদের ১৩ কোটি ও পরে ৬৮ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে মোট ৮১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই পার্ক চালু করা হয়। প্রতি মাসে ঋণের বিপরীতে ৬০ লাখ টাকা কিস্তি দিতে হয়। এখানে ২৬৮ জন কর্মী ছিলেন। এখন ৯০ জনের মতো কাজ করছেন। অন্যদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। কাউকে ৬৫ শতাংশ করে বেতন দেওয়া হচ্ছে। কাউকে ছাঁটাই করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাইডগুলো পড়ে আছে। সুনসান নীরবতা। কোনো কোলাহল নেই।

ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ও চেয়ারম্যান এমরুল কায়েস বলেন, ‘জমি আগেই কেনা ছিল। ব্যাংকঋণ ও কর্মীদের বেতন এবং আনুষঙ্গিক নানা খরচ বাবদ প্রতি মাসে সোয়া কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাসে এক টাকাও আয় নেই। খুবই বেকায়দায় আছি।’

২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ঢুলিপাড়া এলাকার ১১ বিঘা জমি ভাড়া নেন তরুণ উদ্যোক্তা পারভেজ আহমেদ। এরপর তিনি ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগে সেখানে আটটি রাইড, হলরুমসহ নানা ধরনের স্থাপনা তৈরি করেন। জায়গার ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দেন দুই লাখ টাকা। এখানে করোনার আগে ৭৫ জন কর্মী ছিলেন। ইতিমধ্যে ৪৫ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে।

পারভেজ আহমেদ বলেন, ‘করোনার প্রভাবে মুমূর্ষুর মতো বেঁচে আছি। ঋণ আছে। আবার খারাপ লাগছে কর্মীদের জন্য। কোনো রোজগার নেই। রোজগার থাকলে ওরা থাকত।’

২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা নগর উদ্যানের পূর্বাংশে সৌন্দর্যবর্ধন করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। এরপর সেখানে বিনোদনের জন্য একে একে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ধরনের রাইড ও খেলাধুলার সরঞ্জামাদি। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন রাইডের জন্য ১৩ জন ব্যক্তিকে ইজারা দিয়েছে। একটি রাইডের স্বত্বাধিকারী মো. হাসান বলেন, বেশির ভাগ লোকই ঋণ করে রাইড দিয়েছেন। টাকা তো উঠছে না। সবাই ঋণের জালে বন্দী।

কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বালুতুপা এলাকার কুমিল্লা কিংডম, সুয়াগাজী এলাকার ফ্যান্টাসি আইল্যান্ড, লালমাই পাহাড়ের লালমাই ল্যাকল্যান্ড, ডাইনোপার্ক, ব্লু ওয়াটার পার্কসহ পাহাড়ের সব ব্যক্তিমালিকানাধীন পার্কেরও একই দশা। পাহাড়ের কাশবন রিসোর্ট, স্বপ্ন চূড়ায়ও মন্দাভাব বিরাজ করছে। বিশ্বশান্তি পাগ্রোডা বৌদ্ধ বিহারও পর্যটকশূন্য। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রূপবান মুড়া ও ইটাখোলা মুড়া এলাকায়ও পর্যটক নেই।

কুমিল্লা কোটবাড়ী সালমানপুর এলাকায় অবস্থিত ব্যক্তিমালিকাধীন বিনোদনকেন্দ্র ম্যাজিক প্যারাডাইসও পাঁচ মাস ধরে বন্ধ। ছবিটি গত ৩০ জুলাই তোলা। ছবি: এম সাদেক, কুমিল্লা

পর্যটন ঘিরে রেস্তোরাঁ ব্যবসাতেও ধস
গত বছরের বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভবিষ্যতের উন্নয়নে, কাজের সুযোগ পর্যটনে’। বছর না ঘুরতেই করোনার প্রকোপে পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে কোটবাড়ী এলাকায় কাজের সুযোগ তৈরি হওয়া হোটেল ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। হোটেল বয়রা বাড়ি চলে গেছেন। কেউ পেশা বদল করে ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রি করছেন। কেউ আম বিক্রি করছেন। নগরের কান্দিরপাড় এলাকার একটি রেস্তোরাঁর কর্মী হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হচ্ছে। তাই আমের ব্যবসা করছি। এখন আমের দাম বেড়ে গেছে। পুঁজি কম, তাই সেটিও বাদ দিতে হয়েছে। কোনো কাজ পাচ্ছি না।’
কিং ফিশার রেস্তোরাঁর কর্মী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘হোটেল বন্ধ ছিল মাসের পর মাস। এখন সীমিত পরিসরে খুললেও কাস্টমার নেই। আমি এখন ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছি।’

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নাসিরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, পর্যটক নেই। তাই হোটেল ব্যবসা মন্দা।
আবাসিক হোটেল কুমিল্লা ক্লাব, হোটেল রেড রোপ ইন, হোটেল সোনালী, হোটেল ভিক্টোরী ও কুমিল্লার কোটবাড়ী এলাকার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) ৪২০ আসনের আবাসিক কক্ষগুলোও করোনাভাইরাসের কারণে ভাড়া হচ্ছে না।

কুমিল্লা ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মহিবুস সামাদ বলেন, ‘ক্লাবের হোটেল বন্ধ রয়েছে। করোনার কারণে ভাড়া হচ্ছে না। আমরা এখন হোটেলের কক্ষগুলোতে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় যুক্ত চিকিৎসকদের থাকতে দিয়েছি। প্রতি মাসে ক্লাবের সব কর্মীকে বেতন–ভাতা দেওয়া হচ্ছে।’

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. সাদেকুজ্জামান বলেন, কুমিল্লায় প্রত্নসম্পদ দেখিয়ে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করছে। তার ওপর বড় বিনিয়োগ করে অনেকে পর্যটনশিল্পকে বিকশিত করার জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে পার্ক করছেন। করোনাকালের পর সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেলে পর্যটন খাত নিশ্চয়ই ঘুরে দাঁড়াবে।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, শালবন বিহার কুমিল্লা জেলার ব্র্যান্ডিং। করোনাভাইরাসের কারণে শালবন বিহারসহ জেলার বিভিন্ন পার্ক বন্ধ রয়েছে। এ কারণে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।