Thank you for trying Sticky AMP!!

সবুজ চট্টগ্রাম ধুলায় ধূসর

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোনো দিন চট্টগ্রামের বাতাস স্বাস্থ্যকর মানে পৌঁছাতে পারেনি

গাড়ির কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে বাতাস। এতে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। গতকাল বিকেল সাড়ে তিনটায় চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট উড়ালসড়কে

চট্টগ্রাম পাহাড়ঘেরা, আছে সমুদ্রও। কিন্তু পাহাড়-সমুদ্রের মিতালির নগরে এখন গাছের পাতাও অচেনা। চিরচেনা সবুজ বদলে হচ্ছে ধূলায় ধূসর।

বায়ুদূষণে চট্টগ্রামের বাতাস এখন অস্বাস্থ্যকর। বাতাসের মান পরীক্ষা করা আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট আইকিউএয়ার ডটকমে গতকাল ৫ মার্চ এ তথ্যই দেওয়া হয়েছে। এদিন বাতাসের মান ছিল ১১০; যা নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য অস্বাস্থ্যকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বায়ুদূষণে প্রকট হচ্ছে ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগও। হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, ইটভাটা, কলকারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়াসহ নানা কারণে চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ দিন দিন বাড়ছে। পরিবেশগত দিক বিবেচনায় না নিয়ে বেশির ভাগ নির্মাণকাজ চলছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেবল জরিমানা করে দায়িত্ব শেষ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বাতাসের মানমাত্রা পরিমাপের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোনো দিন চট্টগ্রামের বাতাস স্বাস্থ্যকর মানে পৌঁছাতে পারেনি। নগরের আগ্রাবাদ, টিভি স্টেশন ও নাসিরাবাদ এলাকায় বাতাস পরিমাপের তিনটি স্টেশন রয়েছে। প্রতিটি স্টেশন প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার বায়ু পরীক্ষা করতে পারে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম-১০) গ্রহণযোগ্য মান ২৪ ঘণ্টায় ১৫০ পিপিএম। গত ১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বাতাসে তা ছিল ১৭৪ পিপিএম। গত ২০ ফেব্রুয়ারি এটি ছিল সর্বোচ্চ, গ্রহণযোগ্য মানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।

চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তরের (গবেষণাগার) উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামে পাহাড়, গাছপালা ও সমুদ্র রয়েছে। সেদিক থেকে বায়ুদূষণ অনেক কম হওয়ার কথা। কিন্তু অনেকগুলো নির্মাণকাজ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে বায়ুদূষণ অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ধুলার যন্ত্রণা

চট্টগ্রাম নগরের পোর্ট কানেকটিং সড়ক (পিসি রোড) উন্নয়নে প্রকল্পের কাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের এই প্রকল্পের বড় ভুক্তভোগী নগরের হালিশহর ও সদরঘাট এলাকার বাসিন্দারা। ওই সব এলাকার রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে এখন ধুলার আস্তরণ। ধুলা জমেছে রাস্তার পাশের সবুজ গাছের পাতায়ও। আশপাশের ভবনেও একই অবস্থা।

হাটহাজারী সড়কের দোকানদার আসলাম বলছিলেন, ‘দুদিন পর পর রাস্তা কেটে ফেলে। এখন ধুলার জ্বালায় বাঁচি না।’

নগরে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এর মধ্যে রয়েছে লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আউটার রিং রোড, কর্ণফুলী নদীতীরবর্তী সড়ক, জলাবদ্ধতা প্রকল্প ও বাকলিয়া অ্যাকসেস রোড। ধুলাবালু রোধে সিডিএর ব্যবস্থা কম বলে সাধারণ মানুষের অভিযোগ।
এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান শামস বলেন, ‘অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলছে। সব কটিরই পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া আছে। ধুলাবালু এড়ানোর জন্য পানি ছিটানোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারপরও পানি কম ছিটানোর অভিযোগ থাকে। এটা নিশ্চিত করতে ঠিকাদারদের আমরা তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি।’

কর্ণফুলী টানেলের কাজ করছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। এর বাইরে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি বায়ুদূষণে বড় ভূমিকা রাখছে। ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্প ২০২২ সাল পর্যন্ত চলবে বলে জানা গেছে। ফলে খোঁড়াখুঁড়ি থেকে এখনই নিস্তার মিলছে না।
সিটি করপোরেশনও সব সময় পানি ছিটানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারছে না। করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদারদের প্রতি পানি ছিটানোর নির্দেশ থাকে। কিন্তু সব সময় তা করতে চায় না তারা।

দূষণের অন্য কারণ

নগরে বায়ুদূষণের জন্য ১৮টি স্টিল রি–রোলিং মিল ও ৯টি সিমেন্ট কারখানাও দায়ী বলে উল্লেখ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নগরের ১২টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৫১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগেও একাধিকবার জরিমানা করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানা, নির্মাণকাজসহ নানা কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে। আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। ২৭টি কারখানা প্রধানত বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। সব সময় পর্যবেক্ষণে রেখে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘নির্মাণকাজের জন্য আমরা আগেও ঠিকাদারদের জরিমানা করেছি। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখতে অনুরোধ করেছি। তারপরও দূষণ হচ্ছে।’

দূষণে যত ক্ষতি

বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে ভুগছে মানুষ। আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার জন মারা গেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ও বিভাগের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র জুনায়েদ আহমেদ বায়ুদূষণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) বাংলাদেশে বছরে নির্ধারিত মান হচ্ছে ১৫ পিপিএম।

বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সারা বছর নিশ্বাসের সঙ্গে যে পরিমাণ বাতাস মানুষ গ্রহণ করে, তার প্রতি ঘনমিটারে যে ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুকণা ঢোকে, সেটির মান যদি ১৫ মাইক্রোগ্রাম হয়, তবে তা বৈশ্বিকভাবে নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে ৬৩ দশমিক ৪ পিপিএম পিএম ২.৫ গ্রহণ করেছে; যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং বৈশ্বিক হিসাবে নবম সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, দূষণ নির্ধারিত মানমাত্রার মধ্যে রাখতে না পারায় ওই বছর শুধু চট্টগ্রামে ফুসফুস ক্যানসার ও শ্বাসতন্ত্রের রোগে ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।

নগরের দূষণের জন্য অপরিকল্পিত নির্মাণকাজকেই প্রধানত দায়ী করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব উপায়ে নির্মাণকাজ নিশ্চিত করা খুব জরুরি। এ জন্য সিডিএ ও সিটি করপোরেশনের পর্যবেক্ষণ বাড়ানো দরকার। তাহলে নাগরিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। পাশাপাশি ইটভাটা ও কারখানাগুলোকেও নিয়মের মধ্যে আনতে হবে।