Thank you for trying Sticky AMP!!

সরেজমিন উপকূল: 'ভয়, চিন্তা সবই হয় তবু বাড়িই থাকপো'

ঘূর্ণিঝড় আম্পান আসার খবরে বাড়ির টুকটাক কাজ সেরে নিচ্ছেন বনমালী বীর। আজ মঙ্গলবার দুপুরে খুলনার দাকোপ উপজেলায়। ছবি: প্রথম আলো

‘শুনতিছি ঝড় হবে। কালকে রাতি মাইকি প্রচার কুরে গেছে। নিরাপদ জাগায় যাতি বুলেছে। আজগে সকালে হাঁটতি হাঁটতি স্কুলির দিকি গেলাম। সিকেনে লোকজন বলাকওয়া কুরতেছে ঝড় খুব বড় হবে। কখন হবে তা ঠিক কতি পারতেছে না। ভয়, চিন্তা সবই হয় তবু ঝড় যতই আসুক বাড়িই থাকপো। সারা বছর যা খাইয়ে বাঁচপো সেই ধান, গোয়ালি তিনটে গরু আছে সব ফেলিয়ে কোন জায়গায় যাব?’

মোংলা বন্দরের কাছাকাছি সুন্দরবনসংলগ্ন ঢাংমারী গ্রামের বনমালী বীর কথাগুলো বলছিলেন। ৭৪ বছর বয়সী বনমালী এখনো বেশ কর্মঠ। কথা বলার সময় ছেলেকে নিয়ে দড়ি দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্লাস্টিকের ট্যাংকটি শক্ত করে বাঁধছিলেন। জানালেন, একটা এনজিও থেকে কিছু টাকা দিয়ে এটা পেয়েছেন। পানির সংকট বড় সংকট। তাই যত্ন বেশি করতে হয়।

বনমালীর বাড়ি একেবারে ঢাংমারী নদীর কিনারায়। পড়েছে খুলনার দাকোপ উপজেলার মধ্যে। নদী পার হলেই সুন্দরবন। সম্প্রতি এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেড়িবাঁধ হয়েছে। বনমালীর উঠানের মাঝ দিয়ে গেছে ওই বাঁধ। কিছু ক্ষতিপূরণও পেয়েছেন। এখন বনমালীরা বাঁধের বাইরে পড়েছেন। কথা বলার সময় আকাশে ঘন কালো মেঘ আরও জমাট বাঁধতে থাকে, সঙ্গে দু–এক ফোঁটা বৃষ্টি। জোয়ারের উচ্চতাও অন্য দিনের চেয়ে বেশি।

এমন আবহাওয়া দেখে বনমালীর স্ত্রী গীতা বীর বলেন, ‘ঝড়ের কথা শুনলি পরানডা পুঁটি মাছের মতো হুয়ে যায়। এবার ঝড় যে কিরাম হবে কেডা জানে। শুনতিছি খুব জল বাইড়ে যাবে। যদি ঘরে জল উঠে যায় কী হবে! ধান ভাসে গেলি কী খাব।’ উত্তর না খুঁজে পেয়ে নিজেই আবার বলেন, ‘যা হবার হবে চিন্তা করলিই কি আর না করলিই কী।’

গীতা বীর জানান, সিডর, আইলার সময়ও বড় জোয়ার হয়েছিল। সিডরের সময় আশপাশের সব ঘর উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁদের শুধু ঘরের চালা উড়িয়ে নিয়েছিল। আইলার সময় উঠানে ফুটখানেক পানি হয়েছিল। অবশ্য ভাটায় পানি নেমে যাওয়ায় খুব সমস্যা সেবার হয়নি। গত কয়েক বছর দুই-তিনটা ঝড় হয়েছে। তাতেও খুব বড় ক্ষতি হয়নি।

ধান নিয়ে চিন্তা হওয়ার কারণ হিসেবে ওই পরিবারের লোকেরা জানালেন, ঘরে ধান থাকলে চিন্তা করা লাগে না। সাড়ে ৫ হাজার টাকা বিঘা হারে আড়াই বিঘা জমি করে মাত্র ২২ মণ ধান পেয়েছিলেন তাঁরা। গীতা বলেন, এ বছর একদম ধান হয়নি। বুলবুল ঝড়ের কারণে পোকায় ধান শেষ করে দেয়।

এদিকে নতুন করে ঘর তৈরি করবেন বলে ঘরের সরঞ্জাম এবং গোলপাতা কিনে রেখেছেন তাঁরা। এখন দুটি ছোট ঝুপড়ির একটিতে স্বামী-স্ত্রী, অন্যটিতে দুই ছেলে থাকেন। ঝড় হলে ওই ঘর টিকবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান তাঁরা।

আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনীহার কারণ জানতে চাইলে বনমালী বলেন, ‘জীবনে অনেক বড় বড় ঝড় দেখেছি। সাইক্লোন শেল্টার তো এই বেশি দিন হয়নি। দুই কিলোমিটার দূরের স্কুলের ওই খানে আশপাশের লোক গেলেই পূর্ণ হয়ে যায়। আমরা কোনো দিন যাইনি। এই গ্রাম থেকে দু–একজন যায়। ঘর, ধান, গরু, বাছুর ফেলে রেখে যেতে ইচ্ছা করে না।’

বাড়ির পাশের রাস্তায় দুটো ফ্লাগ তুলেছে। ওসবের মানে জানেন না বনমালী। গ্রামের খুব বেশি লোক জানে বলেও মনে হয় না তাঁর। তবে বাতাসে একটু উত্তরে টান আছে। বড় বৃষ্টির ওপর দিয়ে কেটে যেতে পারে বলেই তাঁর মনে হচ্ছে।

কথা বলার একপর্যায়ে কোলে বাচ্চা শিশুকে নিয়ে সেখানে এসে হাজির হন তানজিলা খান। বনমালীদের প্রতিবেশী তিনি। ঝড় কেমন হতে পারে, কী করা যাবে, তানজিলার স্বামী সুমন পাশের নদীতে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যেতে চান, এ সময় যাওয়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়েই পরামর্শ করতে এসছিলেন তিনি।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান আসার খবরে বাড়ির টুকটাক কাজ সেরে নিচ্ছেন বনমালী বীর। আজ মঙ্গলবার দুপুরে খুলনার দাকোপ উপজেলায়। ছবি: প্রথম আলো

তানজিলা বলেন, ‘আশপাশে কোনো দালান নেই। স্লাইকোনও (আশ্রয়কেন্দ্র) বেশ দূরে। স্বামী তা–ও সব সময় কথা শোনে না। যদি বলি চলো যাই। মন না চাইলে তাঁকে সরানোই যাবে না।’

তানজিলা বলেন, ‘আর কত কী যে হবে। ওপরওয়ালা সব জায়গায় কী বড় একটা অসুখ দেছে। আবার এখন ঝড় আসতিছে। নিজেগে ভিটে-বাড়ি নি। লোকের ভিটের পরে থাকি। প্যাটে যখন ছাবালডা ছেলো-সরকার কিছু টায়কা দ্যাতো। তাতে এট্টা ঘর তুলিছি। একটা সংস্থার থাইকে একটা গরু দেছে। গোয়ালনি, গরুডা রান্নাঘরে রাখি। রান্নার চুলো উঠোনে। ঝড়-বাদল হলি কী যে মরণ হবেনে তা বুছতি পারতিছ নে।’