Thank you for trying Sticky AMP!!

স্মৃতিস্তম্ভ হচ্ছে, তবু অরক্ষিত

রাঙ্গুনিয়ার পোমরার গণকবরে নির্মিত হচ্ছে স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু সীমানাদেয়াল না থাকায় অরক্ষিত পড়ে আছে স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে গণকবর। ৩ মার্চ বিকেলে। প্রথম আলো

তারিখ কারও মনে নেই। বাংলা ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। সেই হিসাবে একাত্তরের সেপ্টেম্বর। কিন্তু ঘটনাটির দগদগে ক্ষত এখনো প্রবীণ বাসিন্দাদের মনে। গুনে গুনে পাড়াটির ১৭ জন পুরুষ ও পাশের এক দরজির দোকানিকে বেঁধে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় ছাড়া পায় পাঁচজন। বাকি ১৩ জনকে নিয়ে যায় প্রায় এক কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি জঙ্গলে। সেখানে তাঁদের দিয়ে গর্ত খোঁড়ানো হলো। তারপর সবাইকে হত্যা করে সেই গর্তেই পুঁতে দেওয়া হয়।
১৩ জনই ছিলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরার মধুরাম তালুকদারপাড়ার বাসিন্দা। এই গণকবর স্বাধীনতার এত দিন পড়ে ছিল অবহেলায়। ঝোপঝাড়ে গণকবরের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গণকবর চিহ্নিত করে স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন ২০ বছর ধরেই। অবশেষে স্মৃতিচিহ্ন নির্মিত হচ্ছে সেই গণকবরে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খাইরুল বশর মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই একাত্তরের এই গণকবরে স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণের দাবি জানিয়ে এসেছি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে গণকবরটি চিহ্নিত করে। এখন জেলা পরিষদের অর্থায়নে স্মৃতিচিহ্ন হচ্ছে। এক বছর আগে এটি নির্মাণ শুরু হয়েছে। এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি।’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, স্মৃতিস্তম্ভে এবার ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এ ছাড়া স্মৃতিস্তম্ভে যাওয়ার রাস্তা করতে উদ্যোগ নেবে উপজেলা প্রশাসন।

অবশেষে স্মৃতিচিহ্ন
চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পোমরা ইউনিয়নের গোচরা চৌমুহনী বাজার। এই বাজারের সঙ্গে লাগোয়া দক্ষিণ পোমরা বনবিট। এই বনবিট কার্যালয়ের পেছনের পাহাড়ে সেই গণকবর।
৩ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, গণকবরে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো রাস্তা নেই। জমির আইল ধরেই যেতে হয়। বনবিট কার্যালয় থেকে ৫০ গজের মতো গেলে পেছনে সামাজিক বনায়নের একটি পাহাড়ের পাদদেশে গণকবর। ঝোপঝাড়ে ঢেকে আছে। সীমানা দেয়াল নেই। মাঝেমধ্যে পাশের ধানখেতে বিচরণরত গরু–ছাগল ঢুকে পড়ছে। গণকবরের পাশে নির্মিত হচ্ছে স্মৃতিস্তম্ভ। এখনো শুধু দেয়ালই দাঁড়িয়েছে। অবশিষ্ট কাজ এখনো বাকি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে এক মাসের মধ্যে শেষ হয়। এ জন্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ বরাদ্দ দেয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
নির্মাণকাজের ঠিকাদার আইয়ুব চৌধুরী বলেন, বাকি কাজের জন্য আবার বরাদ্দ দেবে জেলা পরিষদ। এরপর স্মৃতিস্তম্ভটি পূর্ণাঙ্গ হবে।

সেদিন কী ঘটেছিল
তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছিল। সাপ্তাহিক হাটবার ছিল। সবাই বাজার থেকে ফিরে যার যার ঘরে রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় দরজায় লাথি। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় রাজাকাররাও। পাড়াটির ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে বের করে আনা হয় পুরুষ সদস্যদের। এরপর একটি ঘরের শিশুর দোলনার রশি খুলে এনে সবাইকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়চূড়ার হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে (বর্তমানে পোমরা বনবিট কার্যালয়)। মেরে পুঁতে ফেলা হয় ১৩ জনকে। তাঁরা হলেন জগৎ চন্দ্র দাশ, রমনি মোহন দাশ, ফনিন্দ্র দাশ, হরিপদ দাশ, ফকিরচন্দ্র দাশ, দুলাল দাশ, মন্টু আইচ, বিরাজ দাশ, খোকা দে, সচিন্দ্র দাশ, বাবুল চন্দ্র দাশ, সুধীর দাশ ও দরজি ভোছা দত্ত।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই ঘটনার কয়েক দিন আগে মুক্তিযোদ্ধারা একটি সফল অভিযান চালিয়ে বিদ্যুতের টাওয়ার ধ্বংস করে দেন। অভিযানের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নেন পাড়াটিতে। তখন থেকে হানাদারদের নজর পড়ে পাড়াটির ওপর। এরপরই আসে নির্মম আঘাত।

মিনু রাণীর ক্ষোভ
পোমরা শান্তিরহাট স্টেশনের পূর্ব প্রান্তে মধুরাম তালুকদারপাড়া। ছোট্ট টিলার ওপর খাঁজে খাঁজে বাড়িঘর। পাড়ায় ঢোকার মুখেই পাড়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের দেয়ালে তালিকা করে দেওয়া আছে সেই শহীদদের নাম।
৩ মার্চ বিকেলে মধুরাম তালুকদারপাড়া গেলে কথা হয় শহীদ পরিবারের সদস্য মিণু রানী দাশের সঙ্গে। তিনি বিরাজ দাশের স্ত্রী। ষাটোর্ধ্ব এই মহিলার কাছে সেদিনের ঘটনা জানতে চাইলে ক্ষোভ ঝরে পড়ে কথায়। বলে ওঠেন, কেন সেই কথা, জেনে কী হবে? সবাই আসে এসব কাহিনি শুনতে। এরপর আর কেউ খোঁজ রাখে না। যুদ্ধের পর মানুষের ঘরে ঘরে ঝিয়ের কাজ করেছেন। শেষে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে আয়ার কাজ পান। এই সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালিয়েছেন।
এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে শুরু করেন সেই দিনের কথা। তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা বাতি দিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে খেতে বসেন বিরাজ। এমন সময় লাথি মেরে খোলা হয় দরজা। কোনো কথা ছাড়াই বিরাজকে ধরে নিয়ে যায় তারা। এ সময় মিণু রানী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে স্বামী ছাড়িয়ে নিতে গেলে তাঁকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া হয়। পরে জেনেছি তাঁদের মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। স্থানটি চিনলেও কেউ ভয়ে সেখানে যেতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লাশের খোঁজে যান তাঁরা। তত দিনে লাশ তুলে আর সৎকারের অবস্থা ছিল না।’
শহীদ পরিবারের সন্তান সুভাস চন্দ্র দাশ আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার বাবা শুয়ে আছেন সেই গণকবরে। সৎকার করতে পারিনি। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাব সেই ব্যবস্থা পর্যন্ত হয়নি।’