Thank you for trying Sticky AMP!!

স্মৃতি রক্ষায় তিনি 'বিজয় নিশান' ওড়ান ৩০ বছর

সিলেট নগরীর উপকণ্ঠে অবহেলিত লালমাটিয়া বধ্যভূমির প্রায় ৩০ বছর ধরে পরিষ্কার করেন জামাল উদ্দিন। আজ সোমবার মহান বিজয় দিবস সামনে রেখে বধ্যভূমি পরিষ্কার করেন জামাল উদ্দিন। আজ সেখানে পতাকা টানাবেন তিনি। শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সেখানে রোপণ করেছেন দুটি গাছ। এ সময় আপ্লুত হয়ে যান জামাল উদ্দিন। গতকাল সকালে। প্রথম আলো

পেশায় বর্গাচাষি। ভোরেই চলে যান খেতে। দিনমান কাজ করেন। তবে বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের সময় রোজকার নিয়ম একটু পাল্টে যায় জামাল উদ্দীনের। কাজে যাওয়ার আগে ভোরবেলা এক বা দুই দিন ঘণ্টাখানেক আরেকটি কাজ করেন। ৫০ গজ থেকে ১০০ গজ জঙ্গলা স্থান পরিষ্কার করেন।

জামাল যে জায়গা পরিষ্কার করে তা বধ্যধূমির মাঝের স্থান। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা। তাই জায়গাটির প্রতি মায়া জন্মে গেছে জামালের। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের ভোরে একা এসে সাঁটিয়ে দেন জাতীয় পতাকা। বধ্যভূমিতে ওড়ান ‘বিজয় নিশান’।

সিলেট নগরীর উপকণ্ঠের এলাকা লালমাটিয়া বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণে এভাবে প্রায় ৩০ বছর ধরে খাটছেন লালমাটিয়া পাশের গ্রামের জামাল উদ্দীন। আজ সোমবার বিজয় দিবস। এদিনটি সামনে রেখে জামাল গত শনিবার থেকে বধ্যভূমি পরিচ্ছন্ন করেছেন। তাঁর ভাষ্য, বছরে দুবার বিজয় নিশান উড়িয়ে তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে স্থানটি সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন। আর তা রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন ১৯৮৯ সাল থেকে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে সিলেট নগরে প্রবেশের অন্যতম পথ লালমাটিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এ স্থানে গণহত্যা চালিয়েছিল। কিন্তু সেখানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। বধ্যভূমির স্থান চিহ্নিত করতে গিয়ে একজন জামাল উদ্দীনের খোঁজ প্রথমে পায় ‘মুক্তিযুদ্ধের জন্য এক দিন’ কর্মসূচি পালন করা সিলেটের সাইক্লিস্টদের সংগঠন।

সংগঠনটির সমন্বয়ক কাজী সাহি জানান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে গত শনিবার সিলেট থেকে বালাগঞ্জ পর্যন্ত ৪৯ কিলোমিটার হেঁটে পদযাত্রার সময় লালমাটিয়ায় তাঁরা দেখতে পান যে জামাল ওই স্থানটি পরিষ্কার করছেন। সেখানে দুটি গাছ তিনি নিজ হাতে লাগিয়েছেন। তাঁর দেখামতে বধ্যভূমির মূল স্থানটি তিনি পরিচ্ছন্ন করে বিজয় পতাকা উড়িয়ে স্মৃতি সংরক্ষণ করছেন। বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণে জামালের কর্মতৎপরতার বিষয়টি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন তাঁরা।

জামাল উদ্দীনের বাড়ি লালমাটিয়া পাশের ষাটগড় গ্রামে। স্ত্রী, চার ছেলে ও দুই মেয়েসন্তান নিয়ে পরিবার। গতকাল রোববার সকালে বধ্যভূমিতে কর্মরত অবস্থায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আজ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সেখানে ৩০তম বারের মতো ‘বিজয় নিশান’ ওড়ানোর প্রস্তুতি শেষ প্রায়। জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটি পরিষ্কার করতে কোদাল চালাচ্ছিলেন আর কথা বলছিলেন জামাল। কিছুক্ষণ পরপর কপাল থেকে ঘাম মুছছিলেন।

কাজের ফাঁকে জামাল জানান, ৩০ বছর ধরে বছরে দুবার এ কাজ যেন তাঁর জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লালমাটিয়ার নাম তখন ‘বাঘেরগড়’ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ১০ বছর ছিল বয়স। তবে নৃশংসার ঘটনা তাঁর স্মৃতিতে এখনো স্পষ্ট। কৃষক পরিবারের সন্তান জামাল তখন ছাগল চরাতেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যবর্তী একসময় ছাগল চরানোর সময় লালমাটিয়ায় অবস্থানকালে একদল পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে ‘এদারছে আও’ বলে কাছে ডাকে। একটি ছাগল কেড়ে নিতে চায়। শিশু জামাল ছাগল দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তখন স্থানীয় একজন রাজাকার জামালকে সেখান থেকে ফিরে যেতে সহায়তা করে। ফেরার পথে জামাল দেখেন, ১৫ জনকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বাড়ি ফিরে তিনি তাঁর বাবাকে এ কথা বলেন। পরে আরও দুদিন চুপি চুপি সেখানে গিয়ে হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন। আগস্ট মাসের শেষের দিকে জামালকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা ষাটগড় থেকে পালিয়ে বিশ্বনাথ গিয়ে আশ্রয় নেন। ফিরে আসেন স্বাধীনতার পর। জামাল সবার আগে ছুটে যান সেই গণহত্যার স্থানে। তিনি বলেন, ‘শত শত লাশ। মানুষ পাঞ্জাবিদের লাশ মাটিতে পুঁতেনি। কাউয়া-চিলে খাইছে। আর আমরার লাশগুলো মাটিতে পুঁতছিল।’

৩০ বছর ধরে বিজয় নিশান ওড়ানো প্রসঙ্গে জামাল বলেন, ‘এই খানের কিছু খুনখারাপি আমি দেখছি, যা জীবনেও ভোলার নয়। ছোটবেলা দেখা স্মৃতি অনে বড় অইছে। ই-জায়গার নাম আগে বাঘমারা আছিল। মানুষের রক্তে লাল অইগেছিল দেইখা লালমাটিয়া বইলা ডাকা শুরু অয়। এমনিতেই আমি ই-জায়গাখান দেখার মধ্যে রাখতাম। একদিন টেলিভিশনে দেখি যে এই সব জায়গার চিন (চিহ্ন) রাখা অয়। মানুষ স্মরণ করে। আমিও শুরু করছি।’

১৯৮৯ সালের বিজয় দিবস থেকে প্রথম নিশান ওড়ানো শুরু করেন জামাল। এরপর থেকে পরিচ্ছন্নতার কাজও করেন। ১৯৯৬ সালের দিকে মূল স্থানটিতে চিহ্নিত করে রাখতে একটি কদমগাছ ও একটি বটগাছ রোপণ করেন। জামাল বলেন, ‘আমি কিচ্ছু চাই না, আমার খাটাখুটি আর নিশান ওড়ানোর একটাই চাওয়া, জায়গার স্মৃতি থাকুক, একটা স্মৃতিসৌধ হোক।’

বধ্যভূমিতে প্রতিবছর পতাকা ওড়ানো ও স্থান পরিচ্ছন্ন করার কাজে নিবেদিত জামাল উদ্দীন সম্পর্কে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও অবহিত। সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ভবতোষ রায় বর্মণ প্রথম আালোকে বলেন, ‘জামাল গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। বিবেকতাড়িত হয়ে এ কাজ করছেন। বধ্যভূমিতে বছর বছর খাটাখুটি করা, পতাকা ওড়ানো—এসব নিয়ে অনেকেই নানা রকম কটূক্তি করেন তাঁকে। আমাদের দেখে তিনি কেঁদে কেঁদে এসব জানান। আমরা তাঁকে সম্মান জানাই। তাঁর দাবির সঙ্গে একমত হয়ে লালমাটিয়ার বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি আমাদেরও।’