দলের শিল্পীরা বিভিন্ন গ্রামের আচার-অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না পেলেও নিজেরা যেচে গিয়ে বিনা মূল্যে ধামাইল গান পরিবেশন করেন
দলের শিল্পীরা বিভিন্ন গ্রামের আচার-অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না পেলেও নিজেরা যেচে গিয়ে বিনা মূল্যে ধামাইল গান পরিবেশন করেন

হাওরের গান রক্ষায় মহুয়া ধামাইল দল

হাওরের সংস্কৃতির মধ্যে মিশে আছে জল আর জনের সম্পর্ক। বছরের প্রায় আট মাস এখানে পানি। আর চার মাস দিগন্তজোড়া মাঠ। সে সময়টা এখানে কৃষিকাজ হয়। সবুজের মাঝখানে কখনো পানির ঢেউ, কখনো ধানের পাতা বাতাসে দোল খায়। পানি আর সবুজের সমাহার এ দুইয়ের মাঝে বসবাস হাওরাঞ্চলের মানুষের। এরই মধ্যে নানা আচার-অনুষ্ঠানের আনন্দে বেঁচে থাকেন তাঁরা। সেই আনন্দের একটি উপাদান ধামাইল গান।

তবে বিশ্বায়ন আর নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রসারে এ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এখন বিলুপ্তপ্রায়। তবে হাওরের ধামাইল রক্ষায় এবার মাঠে নেমেছেন ১৮ জন নারী-পুরুষ। তাঁরা সবাই ধামাইল গানের শিল্পী। তাঁদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ আর ১৪ জন নারী। তাঁরা ধামাইল গান বাঁচিয়ে রাখতে ‘মহুয়া ধামাইল দল’ নামে একটি সংগঠন করেছেন।

এ গানের দলের পুরুষ সবার বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে। তাঁরা বছরের চার মাস কৃষিকাজ করেন, বাকি সময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বঅহ করেন। নারীদের সবার বয়স ১৪ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে চারজন স্কুলছাত্রী, চারজন কলেজছাত্রী। অন্যরা গৃহিণী।

এ গানের দলটির মধ্যে একজন বেণু মাধব চৌধুরী (৫০)। তিনি বাদে বাকি সবার বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার নগর ইউনিয়নের তাতিয়া নয়াগাঁও এলাকায়। শুধু বেণু মাধবের বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হাওর এলাকায়। বাকিরা হলেন শম্ভু সরকার (৫০), অবিনাশ পুরকায়স্থ (৪৫), মহাদেব সরকার (৫৫), সুপ্তা রানী সরকার (২৬), উষা রানী সরকার (৩৫), বিউটি রানী সরকার (২৮), শেফালি রানী সরকার (২৭), প্রিয়াঙ্কা রানী সরকার (২২), আলপনা রানী সরকার (৩৪), প্রিজা রানী সরকার (১৬), লক্ষ্মী রানী সরকার (১৪), হিয়া রানী সরকার (১৪), বাণী রানী সরকার (৩৫), লিপ্টি পুরকায়স্থ (৩২), ঐশী সরকার (১৪), লিপি সরকার (৩০) ও নিশি সরকার (২২)।

ধামাইল গান পরিবেশনে প্রথমে একজন গানের কলি গেয়ে শুরু করেন, তারপর সঙ্গী নারীরা গেয়ে ওঠেন। প্রথমে গান কিছুটা ধীরগতিতে শুরু হলেও আস্তে আস্তে নৃত্য এবং গীতের গতি বাড়তে থাকে।

ধামাইল একটি প্রাচীন ধারার লোকসংগীত। হাওর অঞ্চলেই এ গানের উৎপত্তি। জন্ম, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, গৃহপ্রবেশ, বিভিন্ন ধরনের ব্রত, পালা-পার্বণ ও ধর্মীয় সব মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এ গান পরিবেশিত হয়। বিশেষ ধরনের এ সংগীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা কখনো নিচু, আবার কখনো ওপরে তুলে পর্যায়ক্রমে করতালি দিয়ে গানের তালে ঘুরে ঘুরে ছন্দে ছন্দে নৃত্য করা হয়। করতালির সঙ্গে মিলিয়ে সামনে ও পেছনে পা বদল করে বৃত্তাকারভাবে নাচ চলে। নাচের সময় পেছনের পায়ের সামনের ভাগ মাটিতে আর গোড়ালি থাকে ওপরে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ডান ও বাঁ পায়ের বদল ঘটাতে হয়। করতালি দিয়ে গানের তাল রক্ষা করা হয় বলে তেমন বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। তবে দু-একটি বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে এ গানে ঢোল গুরুত্বপূর্ণ।

ধামাইল গান পরিবেশনে প্রথমে একজন গানের কলি গেয়ে শুরু করেন, তারপর সঙ্গী নারীরা গেয়ে ওঠেন। প্রথমে গান কিছুটা ধীরগতিতে শুরু হলেও আস্তে আস্তে নৃত্য এবং গীতের গতি বাড়তে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় বয়স্ক নারী বা শিশুকে মধ্যে বসিয়ে গোল হয়ে ২০ থেকে ২৫ জন নারী চারপাশে ঢোলক-বাদ্যের তালে তালে নেচে-গেয়ে ধামাইল গান পরিবেশন করেন। সুরের দিক থেকে কীর্তন ও ভাটিয়ালি ঠাটের অন্তর্গত হলেও এতে দীর্ঘ টান বা মীড়ের দোলা নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে ধামাইল গান তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। আগে যেখানে ওই অঞ্চলের মানুষের বাড়িতে কোনো আচার-অনুষ্ঠান হলেই ধামাইল পরিবেশিত হতো, এখন তেমনটা নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ গান ফিরিয়ে আনতে খালিয়াজুরীর মহুয়া ধামাইল দলটি উদ্যোগী হয়েছে। দলের শিল্পীরা বিভিন্ন গ্রামের আচার-অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না পেলেও নিজেরা যেচে গিয়ে বিনা মূল্যে ধামাইল গান পরিবেশন করে থাকেন।

সংগঠনের অন্যতম সদস্য স্নাতক সম্মান চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী সুপ্তা রানী সরকার বলেন, ‘ধামাইল গান রক্ষায় প্রায় তিন বছর আগে বেণু মাধব চৌধুরী, শম্ভু সরকার, অবিনাশ পুরকায়স্থ, উষা রানী সরকার, শেফালি রানী সরকারসহ কয়েকজনের উদ্যোগে ১৮ জন শিল্পী নিয়ে মহুয়া ধামাইল দল গঠন করা হয়। এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা উদ্যোগী হয়ে গান পরিবেশন করি। তবে আর্থিক সহায়তা পেলে দূরদূরান্তের গ্রামসহ শহরাঞ্চলেও এ পরিবেশন করা সম্ভব হবে।’

ধামাইল গানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা করার জন্য যাঁরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই প্রশংসার পাত্র। তবে ধামাইল গানে যে নতুন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, এ সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার।
অধ্যাপক যতীন সরকার, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অবিনাশ পুরকায়স্থ বলেন, ‘ধামাইল গান এ হাওর অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। ভক্তি ও প্রেমের ভাবাবেশে এ গান পরিবেশিত হয়। বিশেষত রাধা-কৃষ্ণের লীলা, মান-অভিমান, বিরহ, বিচ্ছেদ সবকিছুই গানে ফুটিয়ে তোলা হয়। আকাশসংস্কৃতির প্রভাবে এ লোকসংগীত আজ হুমকির মুখে। আমরা উদ্যোগী হয়ে ধামাইল গানকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

ধামাইল শিল্পী ও স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী বিউটি রানী সরকার বলেন, ধামাইল শুধু রাধা-কৃষ্ণের আখ্যানই নয়, এ গানের মাধ্যমে ব্যঙ্গাত্মক বা হাস্যরসাত্মকভাবে সমাজসচেতনতামূলক গান করা যায়।

ধামাইল শিল্পী বেণু মাধব চৌধুরী বলেন, ‘ধামাইল গান সংরক্ষণ ও মানুষের কাছে তুলতে ধরতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ লোকসংস্কৃতির স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে ধামাইলে শুধু হাতের তালির পাশাপাশি বড়জোর ঢোল-কাঁসর ব্যবহৃত হতো। এখন সেখানে অনেকেই হারমোনিয়াম, বেহালা, বাঁশিসহ অন্যান্য যন্ত্রও ব্যবহার করছেন। এতে অনেক গানের সুর ও কথা পাল্টে যাচ্ছে।’

লোকসংস্কৃতি গবেষক সঞ্জয় সরকার বলেন, ধামাইল গানের ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে জেলা শিল্পকলা একাডেমি, স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার বলেন, ‘ধামাইল গানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা করার জন্য যাঁরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই প্রশংসার পাত্র। তবে ধামাইল গানে যে নতুন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, এ সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। এ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের কারণে ধামাইল গানের প্রকৃত যে রূপ, সেটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে হ্যাঁ, একই রকম থাকবে, এ কথাও আমি বলি না। যাঁরা নতুনভাবে এ গানকে রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তাঁদের আমি আবারও ধন্যবাদ জানাই।’

খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এই ধামাইল সংগঠনটির কথা শুনেছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মেলায় অংশ নিতে আমরা তাঁদের সুযোগ করে দেব। এ ছাড়া ধামাইল গান টিকিয়ে রাখতে সংগঠনের শিল্পীসহ অন্যান্য শিল্পী ও সহযোগীদের সাধ্যমতো পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে।’