Thank you for trying Sticky AMP!!

হাকালুকির অথই ভাসানে মুগ্ধতা

অথই জলের ভাসানে টলমল করে নাচছে হাকালুকি হাওরের বুক। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে। কেউ বলেন আফাল। এখানে ওখানে ভাসমান, দ্রুত ও ধীরে ছুটে যাওয়া ছোট-বড় অনেক নাও। দূরে দূরে সবুজ রেখার মতো গ্রামগুলো যেন ভেসে আছে জলের বুকে। হিজল-করচের বাগান জলের ওপর বুক ভাসিয়ে দাঁড়ানো।

ওপারে যখন সূর্যটা একটু একটু করে ডুবছে, হাওরের ঝিলিক দেওয়া রুপালি বুক আর আগের মতো নেই। বদলাতে শুরু করে। হাওরের জলে তখন লাল-হলুদের মাখামাখি। শেষ বিকেলের রং মেখেছে মেঘদলও। রঙিন মেঘ নেমে আসে হাওরের জলে। টুকরো টুকরো হয়ে ভাসে, ডুবে। হাকালুকি হয়তো প্রতিবারই বর্ষায় এমন রূপের মায়া মেলে ধরে। এবার করোনাকাল বলেই কি না, হাকালুকির হাওরের সেই মুগ্ধতা, সেই মায়া যেন চেনা গণ্ডি ছাড়িয়ে আরও হাজারও চোখকে ছুঁয়ে গেছে। পর্যটকের চোখে হাকালুকি হাওরের সৌন্দর্য উপভোগের মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।

দেশের অন্যতম হাওর হাকালুকির বেশির ভাগই পড়েছে মৌলভীবাজারে।

বন বিভাগ, পর্যটক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে মানুষ অনেক দিন ধরেই ঘরে আটকে আছে। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ জেলার বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ। ঈদুল আজহা উপলক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বের হওয়ার এই সুযোগে কাছের ও দূরের হাজারো পর্যটক ছুটে আসেন হাকালুকিতে। কেউ হাকালুকি হাওরের পারে পারে ঘুরে সময় কাটিয়েছেন। কেউবা নৌকা নিয়ে ভেসে গেছেন হাওরের বুকে।

মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে রং ছড়িয়ে সূর্য ডুবছে। ছবিটি গতকাল সোমবার বিকেলে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

অনেক পর্যটককে দেখা গেছে পর্যটন টাওয়ার থেকে পানিতে ঝাঁপ দিতে। কেউ সাঁতার কাটছেন। অনেকেই নৌকায় করে দল বেঁধে ঘুরেছেন। হইহুল্লোড় করে জলে ভাসছেন।

বন বিভাগের পর্যটন টাওয়ার, বিট কর্মকর্তার কার্যালয়ের ছাদ এবং পারসংলগ্ন বন বিভাগের পর্যটন ভবনে ছিল পর্যটকদের উপচানো ভিড়। গত শনিবার ঈদের দিন থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত তিন দিনে কয়েক হাজার মানুষ ছুটে গেছেন হাকালুকিতে।

পর্যটকের ভিড়ের বেশির ভাগই ছিল হাওরের বড়লেখা অংশে। বড়লেখার তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা এলাকা দিয়ে এই তিন দিন মানুষের স্রোত নেমেছে। হাল্লা এলাকাতে নৌকা নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি। পর্যটকদের চেয়ে নৌকা কম। অনেকেই নৌকা না পেয়ে হাওরের বুকে ভাসতে পারেননি। কিছুটা হতাশ হয়ে ফিরেছেন। তবে হাওরের বুকে না ভাসতে পারলেও ঘুরে বেড়ানোর পুরোটাই বিফলে গেছে, কেউ বলেননি। একদিকে অথই জলের ভাসান, ঢেউ। অন্যদিকে বিকেলের আকাশ রং ঢেলেছে জলে। পাখির ঝাঁক উড়ে গেছে হাল্লা পাখিবাড়ির দিকে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সারা বছরই হাকালুকি হাওরপারের পাখির অভয়াশ্রম মনোহর আলী মাস্টারের হাল্লা পাখিবাড়িতে কমবেশি পর্যটকের আনাগোনা আছে। শীত ও বর্ষায় হাওরের সৌন্দর্য দেখতেও আসেন অনেক মানুষ। দুই ঈদেও ভিড় হয় হাকালুকিতে। কিন্তু অন্য ঈদে হয়তো প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষ আসেন। এবার বেড়েছে কয়েক গুণ। এই কদিনে খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ এসেছেন হাকালুকির কাছে। পর্যটনকেন্দ্রিক কিছু মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে। কেউ নৌকা চালিয়ে, কেউ পর্যটকদের পথ দেখিয়ে, কেউবা মোটরসাইকেলসহ অন্য যানবাহন পাহারা দিয়ে দুপয়সা আয় করছেন।

মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে পর্যটকদের ঢল। চলছে সাঁতার কাটা। ছবিটি গতকাল সোমবার বিকেলে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

হাকালুকিতে ঘুরতে আসা পেশায় শিক্ষক নাজিম উদ্দিন গতকাল বলেন, ‘মাধবকুণ্ডসহ সব পর্যটন স্পট বন্ধ। তাই আমরা হাকালুকি হাওরকে বেছে নিয়েছি। হাওরে হিজল-করচের বাগান আছে। অথই পানি আছে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। একটু শ্বাস নিতে হাজার পর্যটকদের সঙ্গে এখানে এসেছি।’ তাঁর মতে, যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধাটা বাড়ালে এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট হতে পারে।

বন বিভাগের হাকালুকি বিটের দায়িত্বে থাকা জুনিয়র ওয়াইল্ডলাইফ স্কাউট তপন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘অন্যান্য স্থান বন্ধ থাকায় উন্মুক্ত হাকালুকি হাওরে লোকজন ঘুরতে আসেন। ঈদের আগে প্রতিদিন দুই থেকে তিন শ মানুষ আসতেন। ঈদের দিন থেকে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মানুষ আসছে। আমি এখানে একা দায়িত্বে। আমার একার পক্ষে এত মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া কঠিন। আরও কয়েকজন স্টাফ থাকলে ভালো হতো।’

একটা সময় হয়তো সূর্যেরও ক্লান্তি লাগে। অনেক দূরে দিগন্তের ওপারে সূর্য ডুবে গেলে সন্ধ্যা নামে হাকালুকির বুকে। পর্যটনের নৌকাগুলো ততক্ষণে পাড়ে এসে ভিড়েছে। সাদা বক, পানকৌড়ির দল উড়ে গেছে বাসার দিকে। জলের বুকে ভাসমান জেলেনৌকাগুলোতে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকে কুপিবাতি। যেন অন্ধকারের অর্থ এখানে শেষ বলে কিছু নেই, নতুন কিছুর প্রস্তুতি।