Thank you for trying Sticky AMP!!

'এই দুর্দিনে কাউন্সিলর খোরশেদ ভাই দৌড়াইয়্যা আসছেন'

মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদ তাঁর দল নিয়ে কোভিড–১৯ বা এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া লাশের দাফন ও দাহ করছেন। ছবি কাউন্সিলরের ফেসবুক থেকে

টেলিফোনে নিয়তি বণিক বলছিলেন, 'মা, ভাই মারা যাওয়ার পর বাবারে আগলাইয়্যা রাখছিলাম নিজের কাছে। বাবা সারা জীবন মানুষের চিকিৎসা করছেন। অথচ বাবা মারা যাওনের পর কেউ কাছে আসে নাই। আমার আত্মীয়রাও আসে নাই, সবাই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিছিল। তবে এই দুর্দিনে কাউন্সিলর খোরশেদ ভাই দৌড়াইয়্যা আসছেন। আমি বাবার মুখে আগুন (মুখাগ্নি) দিছি, ভাই আমার হাত ধইরা পাশে ছিলেন। এইটাই তো অনেক বড় পাওয়া। বাবার সৎকারে যতটুকু নিয়ম পালন করা সম্ভব, তার সবই করছেন এ কাউন্সিলর ও তাঁর দলের সদস্যরা।'
নিয়তি বণিকের বাবা ৭৫ বছর বয়সী কৈলাস বণিক ছিলেন নারায়ণগঞ্জের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। তিনি ১৯ এপ্রিল আমলাপাড়ায় বাড়িতে মারা যান। নিয়তি বণিক বলেন, 'বাবার যে করোনা হইছিল, তা–ও না। মারা যাওনের আগে গলায় শুধু কাশ জমছিল। এখন তো কেউ মারা গেলেই কয় করোনায় মারা গেছে। তাই বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ আসে নাই। আমার ভাই নাই। চাচাতো ভাইয়েরা আসে নাই। আমিই বাবার মুখে আগুন দিই।'
শ্মশানে বাবার লাশের সৎকার করা নিয়তি বণিকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্থান পায়। নিয়তি বণিকের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদের নামও ছড়িয়ে পড়ে। এই কাউন্সিলর ৮ এপ্রিল থেকে কোভিড–১৯–এ মারা যাওয়া রোগী, করোনার উপসর্গ বা সন্দেহ করা হয়—এমন রোগীর লাশ এবং কিছু ক্ষেত্রে যক্ষ্মাসহ অন্যান্য রোগে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশও দাফন এবং সৎকার করেছেন। শনিবার পর্যন্ত দাফন বা দাহ করেছেন এমন লাশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১। এর মধ্যে হিন্দুধর্মাবলম্বীর পাঁচটি লাশ ছিল। গত শুক্রবার সারা দিনে মোট ছয়টি লাশের পাশে ছিলেন এই কাউন্সিলর। এ কাউন্সিলর জানান, শুধু নিজের ওয়ার্ড নয়, অন্য ওয়ার্ডে কেউ মারা গেলেও ডাক পড়ছে, এমনকি ঢাকা থেকে লাশ আনার দায়িত্বও পড়ছে অনেক ক্ষেত্রে। প্রতিটি লাশের তথ্য থানায় জানানো হচ্ছে এবং দলের সদস্যরাও হিসাব রাখছেন।
মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদ ২০০৪ সাল থেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর ওয়ার্ডের মোট ভোটার ৫৮ হাজারের বেশি। দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তারের শুরুর দিকে ৯ মার্চ এ জনপ্রতিনিধি লিফলেট বিতরণ এবং জুমার নামাজে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করেন। ১৮ মার্চ থেকে নিজ উদ্যোগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার (৬০ হাজার বোতল) বানিয়ে তা বিতরণ করেন। ৩০ মার্চ লাশ দাফন ও দাহ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমতি পেতে আবেদন করেন (অনুমতি পাওয়ার জন্য বসে না থেকে কাজ শুরু করেন)। এ জনপ্রতিনিধি নারায়ণগঞ্জে একটি ল্যাব স্থাপনেরও আবেদন করেন।
মাকছুদুল আলম টেলিফোনে বলেন, 'দেশের এই পরিস্থিতিতে কেউ মারা গেলে স্বজনেরাও ভয়ে কাছে যায় না। লাশ যাতে পড়ে না থাকে, যার যার ধর্ম অনুযায়ী যাতে লাশ দাফন বা সৎকার করা যায়, সেই চেষ্টা থেকেই ব্যক্তিগতভাবে কাজ শুরু করছিলাম। বর্তমানে সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, ফতুল্লা থানাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে সহায়তা পাচ্ছি। আমার পরিবার থেকে প্রথম দিকে আপত্তি আসছে, কিন্তু এখন সবাই মেনে নিছে। এ কাজ করে বাড়িতে ফিরে আমি সবার থেকে আলাদা থাকার চেষ্টা করি। দুবার করোনা টেস্ট করছি, এখন পর্যন্ত দুবারই তা নেগেটিভ এসেছে। আর আমার সঙ্গে এ কাজে অন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা জড়িত, তাই কাজটা আমি হুজুগে করি না। কাজ শুরুর আগে ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি সবার সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দিছি। আমি তো এ কাজের জন্য কাউরে বিপদে ফেলতে পারি না।'
মাকছুদুল আলম বলেন, 'এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর পরও পরিবারের স্বজনেরা ফোন দিচ্ছেন। তবে আমি বা আমরা এত লাশের দায়িত্ব নিয়া তো জানে কুলাইতে পারব না। একসময় তো তাইলে এইটাই পেশা হয়ে যাইব। তা এখন না করি।'
তবে এই দুর্যোগে যাঁরা এ কাজ করতে এগিয়ে এসেছেন, তাঁরা ঝুঁকি আছে তা জেনেই এসেছেন বলেও উল্লেখ করেন মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদ। কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য তিনি প্রতিদিনের কাজের বিস্তারিত তথ্য ফেসবুকে দিচ্ছেন। কোনো পরিবার নাম প্রকাশ করতে না চাইলে তা গোপন রাখছেন। তাঁর দলের সদস্যরা যে ঝুঁকি নিয়ে কাজটি করছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েও ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। স্বেচ্ছাসেবক আরিফুজ্জামান হীরা, হাফেজ আকরাম, জুনায়েদসহ অন্যদের কথা বিভিন্ন পোস্টে লিখেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মো. শফিউল্লার কথা লিখেছেন ফেসবুকে। জানিয়েছেন, এ তরুণ নিজের জমানো টাকা দিয়ে পুরোনো একটি পিকআপ ভ্যান কিনেছিলেন এবং তা নিজেই চালান। এই তরুণ মরদেহ বহনের পাশাপাশি লাশের শেষবিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেবেন বলে জানান এবং এ কাজের জন্য তিনি ভ্যানের ভাড়া নেবেন না বলেও জানান। ফেসবুকে শফিউল্লাহকে 'স্যালুট' জানিয়ে মাকছুদুল আলম খোন্দকার ফেসবুকে লিখেছেন, এ তরুণ ভাড়া নিতে না চাইলেও তরুণের পড়াশোনা খাতে পাশে দাঁড়াবেন তিনি।

মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদ তাঁর দল নিয়ে কোভিড–১৯ বা এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া লাশের দাফন ও দাহ করছেন। ছবি কাউন্সিলরের ফেসবুক থেকে

মাকছুদুল আলম খোন্দকার বলেন, 'দিনে পাঁচটি বা একটি লাশ যা–ই হোক, সবার শেষবিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় আমি উপস্থিত থাকি, যতটুকু পারি কাজে সাহায্য করি। দলের অন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা এতে কাজে উৎসাহ পান। অন্যদিকে কেউ যাতে ভাবতে না পারেন আমি নিরাপদে ঘরে বসে খালি মাতব্বরি করছি।' ২৪ এপ্রিল মাকছুদুল আলম তাঁর অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকে লিখেছেন, 'আজকে আমাদের এক দিনে ষষ্ঠতম দাফন। আমাদের সর্বমোট ২৯তম সৎকার।এখন দাফন করা হলো...অর্থাৎ গত ১০ দিনে একই বাড়ির একই পরিবারের ৩ জনের করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হলো।'
তিনজন মারা যাওয়া এই পরিবারের এক স্বজন টেলিফোনে বলেন, '১০ দিনের ব্যবধানে খালা, মামা ও মামার মেয়ে মারা গেছে। দাফন তো সব খোরশেদ কাউন্সিলরই করছেন। লাশ দাফনের সব খরচও নিজে দিছেন। আক্রান্ত পরিবারের অন্য সদস্যরা যাতে বাড়ির বাইরে না যায়, তাই তাদের জন্য খাবারও দিয়ে গেছেন। আমি এ কাউন্সিলের ওয়ার্ডের ভোটার না, তারপরও আমার পরিবারের জন্য করছেন।'
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ১৬ এপ্রিল তাঁর একজন করোনা পজিটিভ স্বজনের দাশ দাফন করেছেন মাকছুদুল আলম খোন্দকার ও তাঁর দলের সদস্যরা। এ কর্মকর্তা বললেন, পুরো দল নিয়ে তিনি কাজ করছেন। খবর পেয়ে নিজেই হাজির হয়েছেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ায় যে স্বজন মারা গেছেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরাও নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসলাম হোসেন টেলিফোনে জানান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম করোনায় আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া লাশের দাফন ও দাহ করছেন, তা থানা অবগত আছে। প্রায় প্রতিদিনই তিনি এ কাজ করছেন। এই দুর্যোগে এ কাজে এগিয়ে আসার জন্য ওসি সাধুবাদও জানান কাউন্সিলরকে।
নারায়ণগঞ্জের মেয়ের সেলিনা হায়াৎ আইভী টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, 'নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা থাকা অবস্থা থেকে বর্তমান কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম কবরস্থান ও শ্মশানের দেখাশোনা করছেন। কবরস্থান ও শ্মশান তাঁর বাড়ির পাশে হওয়ায় তাঁকেই দায়িত্ব দিই রক্ষণাবেক্ষণের। আর বর্তমানে কোভিড–১৯–এর লাশ দাফন ও সৎকারে এ কাউন্সিলর যে কাজ করছেন, তার প্রশংসা করতেই হবে। তিনবার নির্বাচিত এ কাউন্সিলর ভালো কাজ করছেন। কাজের বিষয়ে তিনি গোছানো এবং সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। এই দুর্যোগের সময় তিনি এগিয়ে এসেছেন, তাই যতটুকু সহযোগিতা করা দরকার, সবই করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। প্রশাসনের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ত্রাণসহায়তা করছেন।'
সেলিনা হায়াৎ বলেন, নতুন করোনাভাইরাসের বিস্তারে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে প্রথম দিকে ভয়ে লাশের কাছে কেউ আসতে চাইতেন না। পরিস্থিতি এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। মূলত সিটি করপোরেশনের সব কাউন্সিলরই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের সৎকারের দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন এলাকার জন্য মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। সবাই মিলেই করোনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে মেয়র কথা শেষে আবারও বলেন, 'কাউন্সিলর খোরশেদ অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেও এ সময়ে তিনি যা করছেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি ভালো কাজ করছেন।'
মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদের ভালো কাজের বিষয়টিকে স্যালুট জানিয়ে ২২ এপ্রিল ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের একজন সাবেক সাংসদ ও রাজনীতিবিদ জোরাম ভান ক্লাভেরি।