Thank you for trying Sticky AMP!!

অদম্য সাহেরা বেগমের গল্প 

সাহেরা কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। 

বরগুনা জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হওয়ার পর পুরস্কার হাতে সাহেরা বেগম

করোনা মহামারির শুরুর দিকে চারদিকে মানুষের মধ্যে ছিল তীব্র আতঙ্ক ও উদ্বেগ। কেউ মারা গেলে সেই বাড়িতে যেমন লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হতো, তেমনি মৃত ব্যক্তির গোসল–দাফনেও ভয় পেতেন স্বজন-প্রতিবেশীরা। সেই সময়ে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে প্রত্যন্ত গ্রামের এক নারী এগিয়ে এসেছিলেন করোনায় মারা যাওয়া নারীদের গোসল করাতে। শুধু তা–ই নয়, মারা যাওয়া অন্য ব্যক্তিদের দাফন-কাফনেও স্বেচ্ছাসেবকদের দলে যোগ দিয়ে তিনি এক মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। 

বরগুনার বেতাগী উপজেলার সদর ইউনিয়নের খোন্তাকাটা গ্রামের এই অদম্য সাহসী নারীর নাম সাহেরা বেগম (৫৫)। তিনি এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এবার বরগুনা জেলায় শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। একই সঙ্গে বরিশাল বিভাগে শ্রেষ্ঠ পাঁচজন জয়িতার মধ্যে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। 

আসলে আমি পুরস্কার পাওয়ার জন্য এসব কাজ করিনি। মানবিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে এসব কাজ করেছি।
সাহেরা বেগম, শ্রেষ্ঠ জয়িতা, বরগুনা

২০২১ সালের জুনের কথা। বেতাগী সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা লুৎফরনেছা বেগম (৮৬) করোনায় আক্রান্ত হয়ে বরগুনা সদর হাসপাতালে মারা যান। তাঁর লাশ বাড়িতে নেওয়ার পর প্রতিবেশীরা ভয়ে লাশের গোসল ও দাফন করা তো দূরে থাক, অনেকেই ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে রাখছিলেন। কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন না। বাড়িজুড়ে আতঙ্কময় এক পরিবেশ। এমন পরিস্থিতিতে নিরুপায় হয়ে লুৎফরনেছা বেগমের ছেলে তৎকালীন বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান। পরে তিনি স্থানীয় রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকদের খবর দেন। তাঁদের সঙ্গে ভয় ও আতঙ্ক উপেক্ষা করে বেতাগী সদর ইউনিয়নের খোন্তাকাটা গ্রামের সাহেরা বেগম এগিয়ে গেলেন সেই বাড়িতে। তিনি লুৎফরনেছা বেগমকে গোসল করান। স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে মিলে তাঁর দাফন সম্পন্ন করেন। 

লুৎফর নেছা বেগমের ছেলে বেতাগী উপজেলার সদর ইউপি সদস্য মাহমুদ শিকদার ওরফে মনির প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন সাহেরা বেগম এগিয়ে না এলে আমার মায়ের গোসল ও দাফনের কাজ যথাযথ সময়ে হতো না, এমনকি সঠিকভাবে দাফন হতো কি না, তা নিয়েও সংশয় ছিল। সাহেরা বেগম সাহসিকতা ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন।’

পাঁচ সন্তানের মা সাহেরা বেগম বরগুনার বেতাগী উপজেলার সদর ইউনিয়নের খোন্তাকাটা গ্রামের মো. শাহজাহান হাওলাদারে স্ত্রী। সেই দিনের স্মৃতির কথা জানাতে গিয়ে সাহেরা বেগম গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, তিনি তাঁর পুরো পরিবারের সদস্যদের এই কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তখন তাঁদের অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছে। কিন্তু গায়ে মাখেননি। করোনায় মারা যাওয়া দুজন নারীকে গোসল করানোসহ মোট ১২ মৃত ব্যক্তির দাফনকাজে সহযোগিতা করেন তাঁরা। 

শুধু করোনায় মৃত ব্যক্তিদের সৎকারে নয়, এই এলাকার আরও অনেক মানবিক কাজ, নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার বিষয়ে উদ্যোগও আছে সাহেরার। নারী উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সাহেরা বেগম ২০১২ সালে স্থানীয় নারীদের নিয়ে আঁধারের নারী কল্যাণ সমিতি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমিতির সদস্যদের নিয়ে বহু বাল্যবিবাহ রোধ করেছেন তিনি। নির্যাতনের শিকার অসহায় নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁর এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার বরিশাল শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেয়া খান ও বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. শওকত আলী জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কর্মসূচির অধীন তাঁকে বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় পুরস্কার তুলে দেন।

সাহেরা বেগম প্রথম আলোক বলেন, ‘আসলে আমি পুরস্কার পাওয়ার জন্য এসব কাজ করিনি। মানবিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে এসব কাজ করেছি। করোনার সময়ে যখন মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারই বাড়ি ছেড়ে লাশ ফেলে রেখে আতঙ্কে পালিয়ে যেত, তখন এই কাজ কাউকে না কাউকে তো করতে হতো। কারণ, একজন মৃত ব্যক্তিকে অসম্মান করে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে পারি না। এ জন্য মৃত্যুভয় ও আতঙ্ক উপেক্ষা আমি এবং আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে এই কাজ করেছি।’

সাহেরা বেগমের মানবিক কাজ নিয়ে বলতে গিয়ে বেতাগী পৌরসভার মেয়র এ বি এম গোলাম কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহেরা বেগম আমাদের নারীদের সাহসের অনুপ্রেরণা। তিনি নিজের তাগিদে ভয়কে জয় করে করোনায় যে ভূমিকা রেখেছেন, তা বিরল। আমরা তাঁর এসব কাজ নিয়ে গর্ব অনুভব করি।’