Thank you for trying Sticky AMP!!

নালায় ডুবল বাবার ঋণের বোঝা হালকা করার স্বপ্ন

নিপা পালিত (২০)

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দাদা-দাদি ও ছোট বোনের জন্য সকালের খাবার তৈরি করেন নিপা পালিত (২০)। কাজ করতে করতে একটু দেরি হয়ে যায়। কলেজের পরীক্ষায় অংশ নিতে দ্রুত ঘর থেকে বের হন। কিন্তু টানা বৃষ্টিতে উঠানে তখন কোমরসমান পানি। ছোট বোন উপমা পালিত (১৮) এগিয়ে দিতে চাইলেও দুর্ভোগের কথা ভেবে নিজেই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন নিপা। কিন্তু তাঁর বের হওয়া যে শেষযাত্রা হবে, সেটা নিপা কিংবা উপমা কেউই জানতেন না।

ঘর থেকে বেরিয়ে কোমরপানি মাড়িয়ে ৩০০ মিটার দূরে যাওয়ার পর বিপদ ঘটে। পানিতে সড়ক ও ঢাকনা খোলা নালা একাকার হয়ে যাওয়ায় নিপা বুঝতে পারেননি। ওই নালায় পড়ে তিনি আটকে যান। সকাল সাড়ে আটটার সময় আশপাশে লোকজনও ছিলেন না। ডাকাডাকি করেও কাউকে পাননি। একপর্যায়ে নিথর হয়ে নিপা মারা যান।

গত সোমবার সকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামী হাট-সংলগ্ন বাদামতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

নিপার দাদা-দাদি জানান, এক যুগ আগে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ব্যবসায় লোকসান হওয়ার পর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে নিপার বাবা-মা নিরুদ্দেশ হন। তিন নাতনির মধ্যে নিপা ও উপমাকে দাদা-দাদির কাছে রেখে যান। এরপর প্রায় সময় বাড়িতে পুলিশ আসত। নিপা বড় হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর বাবার ঋণের বোঝা হালকা করে তাঁদের খোঁজার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।

বাবা–মা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর দাদা–দাদির কাছে মানুষ হয়েছেন নিপা। নিপার কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন দাদি সুমতি পালিত

স্বজনেরা জানান, মৃত নিপা পালিত খাতুনগঞ্জের একসময়ের ব্যবসায়ী উত্তম পালিতের মেয়ে। তিনি হাটহাজারী সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিন বোনের মধ্যে বড় নিপা। মেজ বোন উপমা উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। এক যুগ ধরে তাঁদের বাবা-মা নিরুদ্দেশ। নিপা ও উপমা দাদা-দাদির কাছেই বড় হয়েছেন। তাঁরাই দুই নাতনিকে খাওয়া-পরাসহ পড়ালেখা করাচ্ছেন।

বুধবার বিকেলে নিপার দাদার বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল, মানুষের জটলা। বাড়ির একটি কক্ষে দাদা বাদল পালিত ও দাদি সুমতি পালিত সান্ত্বনা দিতে আসা স্বজনদের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন এবং কিছুক্ষণ পরপর নাতনি হারানোর শোকে কান্না করছেন। স্বজনেরা তাঁদের সান্ত্বনা দিয়ে শোক কাটানোর চেষ্টা করছেন।

বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে নিপার দাদা-দাদিকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ওই বাড়ির সদস্যদের সান্ত্বনা এবং সহায়তা করেন। উপহার ও অর্থসহায়তা নিয়ে ওই বাড়িতে যান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ছাত্র যুব কল্যাণ ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় পরিষদের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোহন দেসহ কয়েকজন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত নৈশপ্রহরী দাদা বাদল পালিত বলেন, ‘এসব দিয়ে আমাদের কী হবে। বাড়িতে পানি ঢোকার পথ বন্ধ করতে পারলে আর নালায় ঢাকনা থাকলে আমার এই ক্ষতি কী হতো? এই দায় কার। সিটি করপোরেশনের নয় কি?’

বড় বোন নিপা পালিতের সঙ্গে ছোট বোন উপমা পালিত

নিপা পালিতের ঘর থেকে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের দূরত্ব ৬০০ মিটারের মতো। তাঁর বাড়ি থেকে মূল সড়কে যাওয়ার পথে এক পাশে অন্তত ৩০০ মিটার এলাকার নালায় কোনো ঢাকনা দেখা যায়নি।

নিপার ছোট বোন উপমা পালিত বলেন, দুই বোনকে দাদা-দাদি অনেক কষ্টে বড় করেছেন। অবসর বয়সেও তাঁদের সব খরচ বহন করছেন। আপুর আশা ছিল, চাকরি পাওয়ার পর বাবার ঋণ শোধ করে তাঁদের খুঁজে বের করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন। দাদি সুমতি পালিত বলেন, অনেক কষ্টে তাঁর দাদা পেনশনের টাকায় ঘরখরচ ও দুই নাতনির লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। আশায় ছিলেন, বছর দু-এক পর নাতনি চাকরি পাবেন। সচ্ছলতা আসবে। তাঁর দীর্ঘদিনের দুঃখ ঘুচবে। কিন্তু পানিতেই সব শেষ বলে কেঁদে ফেলেন সুমতি।

হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, হাসপাতাল থেকে তাঁরা নিপার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।