Thank you for trying Sticky AMP!!

জৌলুশ হারাচ্ছে ‘ঢাকের হাট’

প্রতিবছর মণ্ডপ বাড়ছে। কিন্তু হাটে ঢাকিদের অংশগ্রহণ, চাহিদা, কদর—সবই কমছে।

ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পূজারিদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে একটি ঢাকের দল। গতকাল কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী পৌর সদরের পুরান বাজার এলাকায়

দুর্গাপূজার প্রধান অনুষঙ্গ ঢাক। আর পূজায় ঢাকের চাহিদা মেটাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে প্রতিবছর বসে ‘ঢাকের হাট’। হাটে চলে ঢাকি আর পূজারির দর-কষাকষি। শেষে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে দলটি মহাষষ্ঠীর প্রতিমার আসনে প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত সময়ের জন্য একটি মণ্ডপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই হাটের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের অধিক সময়ের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে কটিয়াদীর ঢাকের হাট ঐতিহ্য ও জৌলুশ হারাচ্ছে। প্রতিবছর মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু হাটে ঢাকিদের অংশগ্রহণ, চাহিদা, কদর—সবই কমছে।

এ ক্ষেত্রে আয়োজক ও ঢাকিদের দাবি, প্রযুক্তির উৎকর্ষ হাটের ঐতিহ্যে বড় আঘাত হেনেছে। বিশেষ করে মুঠোফোন প্রায় সবার জন্য সহজলভ্য হওয়ার পর আঘাতটি আরও বড় হয়। এখন পূজারিরা আর হাটে এসে দরদাম করে ঢাক দল নির্বাচন করতে আগ্রহী নন। তাঁরা তার আগে দলপ্রধানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। মুঠোফোনেই দরদাম করে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পড়েন। আর বায়না আসে বিকাশে।

একটি ঢাক দলের প্রধানের নাম সুমন দাস। বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা সদরে। এক যুগের অধিক সময় দল নিয়ে তিনি কটিয়াদীর হাটে আসেন। তবে কয়েক বছর ধরে আর আসার প্রয়োজন হয় না। কারণ, তাঁর সঙ্গে এখন পূজারিরা মুঠোফোনে যোগাযোগ করে চুক্তিবদ্ধ হন। এবারও চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন মুঠোফোনেই। সুমন দাসের সঙ্গে গতকাল শুক্রবার বিকেলে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, হাটে এলে ভালো লাগত। অনেকের সঙ্গে দেখা হতো। কিন্তু ফোনে সব হয়ে যাচ্ছে। এবার তাঁর দল ৪৫ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়।

সুমন জানান, তাঁর পরিচিত প্রায় সবাই চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন ফোনে। অথচ কয়েক বছর আগেও তাঁরা কটিয়াদীর হাটে আসতেন।

এবার হাট বসেছে বুধবার থেকে। গতকাল ছিল হাটের শেষ দিন। যাঁরা চুক্তিবদ্ধ হতে পারবেন না, কেবল তাঁরা আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত হাটে অবস্থান করবেন।

গতকাল গিয়ে দেখা যায়, কিছু সময় বিরতি দিয়ে কাঁসর, সানাই, বাঁশি, করতাল ও খঞ্জনি নিয়ে ঢাকিরা দল বেঁধে বাদ্য বাজাচ্ছেন। পূজারিরা বিভিন্ন দলের কাছে গিয়ে বাদ্য বাজানো দেখছেন এবং শুনছেন। কারণ, কোন দলের কত মূল্য হবে, তা নির্ধারিত হয়ে থাকে উপস্থিত মুনশিয়ানা পরীক্ষার মাধ্যমে। বাজনার তালে নাচ আর নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে পূজারিদের নজর কাড়ারও চেষ্টায় রয়েছেন ঢাকিরা। তবে এবার হাটে ঢাকি আর পূজারির সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে কম। সব মিলিয়ে হাটে ছিল মাত্র ৮০টি ঢাক দল। পূজারিও কম। এই সংখ্যা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত মাত্র ২৩টি দল চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছে। বড় একটি অংশ চুক্তির বাইরে থেকে গেছে। এ নিয়ে ঢাকিদের মন ভালো নেই।

একটি ঢাক দলের প্রধান মহাদেব দাস। তিন সদস্যের দল নিয়ে তিনি এসেছেন বিক্রয়পুর থেকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলেও তিনি কোথাও চুক্তিবদ্ধ হতে পারেননি।

কষ্ট নিয়ে মহাদেব বলেন, যত বড় ঐতিহ্য, তত পূজারি নেই। তিনি জানান, এখানে আসার আগে এক জায়গায় ফোনে কথা হয়েছিল। দরদামে না মেলায় শেষে হাটে আসেন। এখন তাঁর আফসোস, ফোনে কেন সাড়া দিলেন না।

রিপন দাস ও তাঁর দলের সদস্যরা হাটের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ঢোল, করতাল ও বাঁশি বাজিয়ে পূজারিদের দৃষ্ট কাড়ার চেষ্টায় আছেন। আট সদস্যের দল তাঁর। কিন্তু বিকেল পর্যন্ত পূজারিদের দৃষ্টিসীমার বাইরে ছিলেন তিনি। রিপন দাস বলেন, গত বছর পেয়েছেন ৮০ হাজার টাকা। এবার চাহিদা ছিল এক লাখ। এখন তাঁর অপেক্ষা, কোথাও থেকে ফোন পাওয়ার। তিনি জানতে পেরেছেন, তাঁর সঙ্গের অন্যদের বায়না হয়েছে ফোনে। হাটে এসে ভুল করলেন কি না, এই চিন্তা এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কটিয়াদীর ঢাকের হাটের ঐতিহ্য ঝুঁকিতে পড়ার কথা ভালো করেই জানা আছে আয়োজকদের। জৌলুশ হারানোর পেছনে তাঁরাও প্রযুক্তিকে দায়ী করছেন।

হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য লিটন সাহা। তিনি বলেন, দেড় যুগ আগেও সারা দেশ থেকে হাটে অন্তত ৫০০ ঢাকি আসতেন। এখন সেটি কয়েক গুণ নিচে নেমে গেছে। ফোনে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পর সংখ্যাটি কমছে।

গতকাল হাট পরিদর্শনে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খানজাদা শাহরিয়ার বিন মান্নান, কটিয়াদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাদত হোসেনসহ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সদস্যরা।