Thank you for trying Sticky AMP!!

‘মনে অয় ভিটাও থাকব না’ 

নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ফাটল ধরেছে। ভাঙন–আতঙ্কে গাছপালা কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

নদীতে তীব্র ঘূর্ণি স্রোত। গভীরতাও বেশি। জিও ব্যাগ ফেলা হলেও অনেক সময় সেগুলো সরে যাচ্ছে। ঠেকানো যাচ্ছে না ভাঙন। গতকাল দুপুরে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বড়নওপাড়া ও সুন্দিসার গ্রামের মধ্যখানে

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় আবারও পদ্মার ভাঙন শুরু হয়েছে। উপজেলার বেজগাঁও ইউনিয়নের সুন্দিরসার এলাকায় গত মঙ্গলবার থেকে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েক দিন আগে উপজেলার লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের বড়নওপাড়া এলাকায় ভাঙনে ভিটামাটি হারায় ২১টি পরিবার। কয়েক দিনের ব্যবধানে পাশাপাশি দুটি এলাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় আতঙ্কিত সেখানকার বাসিন্দারা।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বেজগাঁও ইউনিয়নের সুন্দিরসার গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদীর তীরবর্তী জায়গায় বড় বড় ফাটল। এ এলাকায় এক বছর আগে ফেলা জিওব্যাগ সরে গিয়ে মাটি ভেঙে নদীতে পড়ছে। ভাঙন–আতঙ্কে গাছপালা কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা জানান, ৫ অক্টোবর পার্শ্ববর্তী লৌহজং–তেউটিয়া ইউনিয়নের বড়নওপাড়ায় আকস্মিক ভাঙনে মুহূর্তেই চারটি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরে ভাঙন–আতঙ্কে আরও ১৭টি পরিবার তাদের বসতঘর সরিয়ে গৃহহীন হয়েছে। ওই এলাকার পরিস্থিতি এখনো খারাপ। সেখানে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। যেকোনো সময় আবারও ভাঙতে পারে। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার থেকে একই তীরের বেজগাঁওয়ের সুন্দিসারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি দুটি ইউনিয়নের দুই গ্রামের শতাধিক পরিবার ভাঙন–আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

সব সময় ভয়ে নদীর দিকে চাইয়া থাকি। বাড়ির গাছগাছালি কাটা শুরু করছি। যদি দ্রুত ভাঙন বন্ধ না হয়, বাড়িঘর ভাইঙ্গা চইলা যামু।
শিরিন বেগম, স্থানীয় বাসিন্দা

৪০ বছর আগে সাফিয়া বেগম (৫৭) সুন্দিসার এলাকার আবু তাহের মোল্লার স্ত্রী হয়ে আসেন। এখানে তাঁর চার ছেলেমেয়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্তমানে ছেলের বউ, নাতনিসহ আটজনের সংসার তাঁর। ভালোই কাটছিল তাঁদের দিন। কিন্তু গত তিন বছরের অব্যাহত ভাঙনে ৬১ শতক জমি হারিয়েছে পরিবারটি। এবার বসতবাড়ি ভাঙনের মুখে পড়ায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পরিবারটির সদস্যদের চোখেমুখে। সাফিয়া বেগম বলেন, ‘এখন যেখানে নদী, তার ৬০০-৭০০ হাত দূর পর্যন্ত আমাদের জমি ছিল। দামি কাঠগাছের বাগান ছিল। গত তিন বছরে ভাঙতে ভাঙতে সব শেষ হইছে। রাইত–দিন ভয়ে পার হইতাছে। এইবার মনে অয় ভিটাও আর থাকব না।’ একই এলাকার শিরিন বেগম (৫০) বলেন, ‘পদ্মা সব খাইছে। এখন ভিটাটাও খাইব। সব সময় ভয়ে নদীর দিকে চাইয়া থাকি। বাড়ির গাছগাছালি কাটা শুরু করছি। যদি দ্রুত ভাঙন বন্ধ না হয়, বাড়িঘর ভাইঙ্গা চইলা যামু।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মা সেতু হওয়ার পর শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বিআইডব্লিউটিএ–ও নদী খনন, চ্যানেল ঠিকঠাক রাখার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া গত বছর পদ্মা নদীতে অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে শত শত ড্রেজারের মাধ্যমে যত্রতত্র থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। এতে পদ্মার মাঝামাঝি চর জেগে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে মূল প্রবাহ লৌহজংয়ের দিকে চলে এসেছে। এর মধ্যে নদীর তীর ঘেঁষে বড় বড় বালুবাহী বাল্কহেডসহ সব ধরনের নৌযান চলছেই। এতে বড় বড় ঢেউ তীরে আঘাত করছে। এ ছাড়া নদীতে প্রচণ্ড রকম ঘূর্ণিস্রোত বইছে। সব মিলিয়ে তীরবর্তী এলাকার তলদেশের মাটি সরে গিয়ে ভাঙন শুরু হয়েছে।

পদ্মার ভাঙন রোধে ২০২২ সালের ১৮ মে পদ্মার বাম তীর নামে লৌহজংয়ের খড়িয়া থেকে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দিঘীরপাড় পর্যন্ত ৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার অংশে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন পানিসম্পদমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক। ৪৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজটি শুরু হয়। পরে লৌহজংয়ের লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দেয়। চলতি বছর আরও ৪ দশমিক ৬২ কিলোমিটার বাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৭২ কিলোমিটারের কাজ শুরু হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭৮ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মুন্সিগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তী প্রথম আলোকে বলেন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সে জন্য মূল পদ্মা নদীর প্রবাহ লৌহজং অংশের দিকে সরে আসছে। কয়েক দিন ধরে বেজগাঁও ও লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে ইতিমধ্যে নতুন করে ১০ হাজারের বেশি জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। যেখানে ভাঙন দেখা যাচ্ছে, সেখানে জরুরি ভিত্তিতে কাজ চলছে। নদীর পানি কমলে জরিপ করা হবে। স্থায়ী প্রতিরোধের কাজ আগামী নভেম্বর থেকে শুরু হবে। বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে কথা বলে নদীর গতিপথ ঠিক রাখতে খননের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

পদ্মার ভাঙনে লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের আংশিক এবং পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত ২১ জনের তালিকা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ঘর সরিয়ে নেওয়া বাবদ ছয় হাজার টাকা করে নগদ এবং দুই বান্ডিল করে ঢেউটিন দেওয়া হয়েছে। যাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।