Thank you for trying Sticky AMP!!

অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু করে শীত মৌসুমে পাখির আনাগোনা থাকে বেশি। গতকাল পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা ইউনিয়নের কৈটোলা গ্রামে

পাখিই তাঁর স্বজন, পাখিই পরিবারের সদস্য

বাড়িটির আয়তন সাড়ে পাঁচ বিঘা। জঙ্গলঘেরা বাড়িটির কাছে যেতেই পাখির কলতান কানে ভেসে আসে। আর বাড়ির ভেতর ঢুকলে চোখে পড়ে বিভিন্ন গাছে পাখির ঝাঁক। পাবনার বেড়া উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে কৈটোলা গ্রামে বাড়িটির অবস্থান।

বাড়িটির মালিক আকাশকলি দাস (৮৮)। চিরকুমার মানুষটি স্থানীয়ভাবে ‘পাখিবন্ধু’ বলে পরিচিত। বিশাল ওই বাড়িতে সঙ্গে থাকেন তাঁর বোন ঝর্ণা দাস (৭০)। পাখিই যেন তাঁদের স্বজন ও পরিবারের সদস্য। এখানে পাখির কেউ ক্ষতি করতে পারেন না। আকাশকলি দাস দিনরাত পাখিগুলোকে পাহারা দিয়ে রাখেন; দেন পর্যাপ্ত খাবার। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাখি দেখতে সেখানে ভিড় জমান লোকজন।

অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু করে গোটা শীত মৌসুম দর্শনার্থীর ভিড় থাকে বেশি। এ সময় দেশি পাখির সঙ্গে পরিযায়ী পাখিও আশ্রয় নেয়। বেশি দেখা যায়, দেশি বক, কানি বক, পানকৌড়ি, শামুকখোল, ঘুঘু, দোয়েল, শালিক, ছোট সরালি, বড় সরালি, খঞ্জনা ও পাতিহাঁস।

আকাশকলি দাস স্থানীয়ভাবে ‘পাখিবন্ধু’ নামে পরিচিত। তিনি পাখির খাবারের ব্যবস্থা করেন

শুরুর কথা
শুধু পাখি নয়, যেকোনো প্রাণীর প্রতি আকাশকলি দাসের ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলা থেকেই তাঁর নেশা ছিল রাস্তা থেকে বিপদে পড়া কুকুর ও বিড়াল বাড়িতে এনে আশ্রয় দেওয়া। ১০-১৫টি করে কুকুর ও বিড়াল সব সময় থাকে তাঁর বাড়িতে। ৪৫ থেকে ৫০ বছর আগের কথা তুলে ধরেন আকাশকলি। তিনি জানান, পৈতৃক সূত্রে তিনি যে বাড়িটি পেয়েছেন, তার বেশির ভাগই জঙ্গলে ভরা। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় গাছ। সেই সব গাছে পাখির ভিড় লেগেই থাকত। এসব পাখির প্রতি চোখ পড়ে শিকারিদের। বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি পাহারা দেওয়া শুরু করেন। পরে শিকারিরা আর আসতে সাহস করেননি। এরপর তিনি পাখিদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। ভাত রেঁধে ভাত রেঁধে গাছের নিচে বেশ কিছুটা অংশজুড়ে কলাগাছের পাতায় পাখির জন্য রাখতে শুরু করেন। নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার পেয়ে পাখির সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে। আকাশকলি এখনো পাখিদের প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন।

পাখিগুলো আশ্রয় নিয়েছে বড় বড় গাছে

আকাশকলি বলেন, ‘পাখিদের না খাইয়ে খেতে ইচ্ছা করে না। ওরা আমার সন্তানের মতো। আসলে ওরা ভালোবাসা বোঝে। তাই আমার বাড়িতে এসে ওরা ভিড় করে।’
আকাশকলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। পৈতৃক সূত্রে ওই বাড়ি ছাড়াও পেয়েছেন কৃষিজমি। বাড়ির একদিকে রয়েছে গরুর একটি খামার। রাখাল ও কাজের লোক দিয়ে খামার ও কৃষিজমি দেখাশোনা করেন। দিনের বেশির ভাগ সময়ই তাঁর কাটে বাড়ির পাখির পরিচর্যায়। তবে বয়সের বারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ায় আগের মতো অনেক কিছুই আর করতে পারেন না।

জঙ্গলঘেরা সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির বাড়িতে গড়ে উঠেছে পাখির অভয়াশ্রম

পাখি অভয়াশ্রম
আকাশকলির বাড়িতে পাখি থাকার কথা ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে আরও বিভিন্ন এলাকায়। পাখি দেখতে দিন দিন দর্শনার্থীর ভিড় বাড়তে থাকে। পাখির এমন নিরাপদ আবাসস্থলের বিষয়টি নিয়ে পরিবেশবাদী বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) আইইউসিএন কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়। তাদের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মৎস্য অধিদপ্তরের ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (ডব্লিউবিআরপি) বাড়িটিকে ‘পাখি অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে। তবে ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করা হলেও এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে বিশেষ কোনো সহযোগিতা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

আকাশকলি দাসের স্বজন বলতে একমাত্র বোন ঝর্ণা দাস

সরেজমিন এ‍কদিন
আকাশকলির বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গছে কাগেশ্বরী নদী। বাড়ির পাশেই নদীর পাড়ে আবদুল ওয়াদুদের চায়ের দোকান। সেখানে চা–পান করতে করতে আড্ডা দিচ্ছিলেন কৈটোলা ও পাঁচুরিয়া গ্রামের ১০-১৫ জন। আকাশকলির প্রসঙ্গে কথা তুলতেই সবাই বলেন, পাখির প্রতি তাঁর (আকাশকলি) ভালোবাসা সত্যিই বিরল।

কৈটোলা গ্রামের ওমর আলী ও কালু সরদার বলেন, তাঁর (আকাশকলি) বাড়িটি এখন এই গ্রামের গর্ব। বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখানে পাখি দেখতে আসেন। পাখির কিচিরমিচির ও কলকাকলিতে গ্রামের সবাই মুগ্ধ হয়ে থাকে।

এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা শেষ করে আকাশকলির বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই পাখির কলরব কানে আসে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা ছাপরা ঘর। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি পাখিগুলোকে দেখছিলেন। প্রতিটি গাছেই রয়েছে অসংখ্য পাখি। আর গাছের নিচে পাখির বিষ্ঠায় সাদা হয়ে আছে। এরই এক পাশে পাঁচ-ছয়টি কলাপাতা পেতে রাখা হয়েছে। আকাশকলি জানান, একটু পরেই সেখানে পাখির জন্য ভাত দেওয়া হবে। ওই বাড়িতে অবস্থানকালে বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীকেও আসতে দেখা যায়।

বেড়া উপজেলার মনজুর কাদের মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সময় পেলেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আকাশকলি দাসের বাড়িতে পাখি দেখতে যাই। তিনি শুধু পাখিদের রক্ষা করছেন না, পরিবেশকেও বাঁচিয়ে রাখছেন। তাঁর মতো আরও কিছু মানুষ থাকলে আমাদের পরিবেশ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচত।’

বেড়া উপজেলা বন কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি তাঁর অভয়াশ্রমে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর অভয়াশ্রমে সহায়তা করার জন্য আমার সব সময় নজর থাকবে। অভয়াশ্রমের বাইরেও কেউ যাতে পাখি শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে সব সময় খেয়াল রাখছি।’