Thank you for trying Sticky AMP!!

বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে সময় কাটান বাসিন্দারা। গতকাল বুধবার গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে

ঈদে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা, ভালো খাবারেও মন ভরে না

মো. রফিকুল ইসলাম (৬৮)। পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। ঢাকার বড় বড় হাসপাতালে কাজ করেছেন। চার ছেলের দুজন চিকিৎসক আর দুজন প্রকৌশলী। তাঁরা সবাই থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। পাঁচ বছর আগে স্ত্রীও যান ছেলেদের কাছে। রফিকুল ইসলাম থাকেন গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে। নিঃসঙ্গ, একা। বৃদ্ধ এই বাবা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অতীতে সন্তানদের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান।

রফিকুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। থাকতেন রাজধানীর আজিমপুরে। এখন জায়গা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। গতকাল বুধবার চোখের পানি মুছতে মুছতে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক দিন পরই ঈদ। ছেলেদের কথা মনে পড়ে। স্ত্রীকেও ভুলিনি। সবাই থাকতেও আজ আমার কেউ নেই। কয়েক বছর ধরে এখানে ঈদ কাটছে। বুকে ভেতর অনেক কষ্ট, কারও কাছে বলতে পারি না। এখানেও ঈদের সময় ভালো-মন্দ খাবারদাবার দেয়। কিন্তু সেই খাবারে তো আর মন ভরে না।’

রফিকুল ইসলাম দুই ছেলেকে ঢাকায় লেখাপড়া করিয়েছেন আর দুই ছেলে পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার যত উপার্জিত সম্পদ, নগদ টাকা, সব নিয়ে গেছে ছেলেরা। তা নিয়ে যাক, কোনো আফসোস নেই। কিন্তু কেউ বৃদ্ধ বাবার খোঁজও রাখে না। বাবা হিসেবে আমি সব সময় চাই ছেলেরা ভালো থাকুক। আমি চাই, ওরা এসে আমাকে নিয়ে যাক।’

রফিকুল ইসলামের মতো শতাধিক বৃদ্ধ নারী-পুরুষ এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। তাঁদের অনেকেই পরিবার থেকে বিতাড়িত। কেউ ক্ষোভে পরিবার ছেড়ে এখানে চলে এসেছেন। কারও কারও দেখাশোনা করার মতো কেউ না থাকায় ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমে অপরিচিতজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করলেও চরম অসহায়ত্ব আর একাকিত্ব কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁদের। তবু যেন বৃদ্ধাশ্রমই কারও কারও কাছে শান্তির জায়গা। বৃদ্ধাশ্রমের লোকজন নানাভাবে তাঁদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে যান। প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসা প্রদান করেন। বিনা মূল্যে খাবার, ওষুধসহ পোশাকও দেওয়া হয়। ঈদেও নতুন কাপড়ের পাশাপাশি তাঁদের জন্য বিশেষ খাবার রান্না করা হয়।

বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে সময় কাটান বাসিন্দারা। গতকাল বুধবার গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে

বৃদ্ধাশ্রমের নিবাসী ইফতেখার আহমেদ (৭০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৯১ সালে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় তাঁর। একমাত্র ছেলে থেকে যান মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলে এখন বেশ বড় হয়েছে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কেউ দেখা করেন না। বয়স হওয়ায় আগের মতো কাজকর্ম করতে পারেন না। ২০২১ সালে তিনি নিজেই এ বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসেন। ভালোই আছেন। তারপরও ছেলেটার জন্য মন কাঁদে, উল্লেখ করে ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘ঈদে একসঙ্গে সেমাই-পোলাও খাব। কিন্তু সেই কপাল তো আমার নেই। সে কোথায় থাকে, কী করে, তা-ও আমি জানি না। সে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক। ঈদেও আনন্দে, ভালোভাবে কাটুক, এ দোয়াই করি।’

মো. নুরুজ্জামানের বৃদ্ধাশ্রমে এবারই প্রথম ঈদ। তিনি ছিলেন প্রকৌশলী। গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। স্ত্রী-সন্তানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গত বছরের মার্চে বৃদ্ধাশ্রমে উঠেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে হলেও তাদের অপমান করার কথা মনে পড়লে মনটা বিষিয়ে ওঠে। এত দিন হয়ে গেল, কেউ আমার কোনো খোঁজও নেয়নি। আমিও নিইনি। আজ আমার সবাই থাকতেও যেন কেউ নেই।’ কথা বলতে বলতে দুচোখ ছলছল করে ওঠে তাঁর।

Also Read: ঈদে সন্তানদের কথা মনে করে ‘কষ্টে বুক ফাটে’ বৃদ্ধাশ্রমের জমিলা, রইসদের

বৃদ্ধাশ্রমে নারীদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা বেলি আক্তার বলেন, ‘অসহায় পরিবারহারা এ মানুষগুলোর সেবা করতে পেরে বেশ আনন্দ পাই আমি। আমি তাঁদের ভেতর আমার বাবা-মাকে খুঁজে পাই। তাঁদের সেবাযত্ন করি। এখানে সকাল-সন্ধ্যা সবার জন্য আমি কাজ করি। আমার একটুও খারাপ লাগে না। সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকি। এই যে ঈদ আসছে, সবাই আমরা একটা পরিবারের মতো। সবাই একসঙ্গে ঈদ করব।’

গাজীপুর সদরের মণিপুর বিশিয়া এলাকার খতিব আবদুল জাহিদ ১৯৮৭ সালে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকায় ১২ কক্ষের একটি বাড়িতে এই বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটিকে মণিপুর বিশিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৫ সালের ২১ এপ্রিল নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটির সম্প্রসারিত অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই সময় থেকেই কেন্দ্রটিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে এমন শতাধিক মানুষের।

বৃদ্ধাশ্রমটির তত্ত্বাবধায়ক রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ৬০ বছরের বেশি বয়সী যেসব মানুষের পরিবার দেখভাল করতে পারে না, যত্ন নেওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, তাদের কথা চিন্তা করে এ বৃদ্ধাশ্রম বানানো হয়েছে। বর্তমানে এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মধ্যবিত্ত পরিবারের ৮০ জন বৃদ্ধ এবং ৭০ জন বৃদ্ধা বসবাস করছেন।