Thank you for trying Sticky AMP!!

বরাদ্দ পাননি ‘বীর নিবাস’

যাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁদের কেউ সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা, কেউ বিত্তশালী। তাঁদের অনেকেই জমিজমাসহ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।

মানিকগঞ্জ জেলার মানচিত্র

একাধিক বাড়ির মালিক, নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের মালিক; এমনকি নিজেরা ও তাঁদের সন্তানেরাও সচ্ছল—এমন বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন। অথচ দিনমজুরি করেন, মাটির ঘরে বসবাস, আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়—এমন বীর মুক্তিযোদ্ধারা ‘বীর নিবাস’ বরাদ্দ পাননি। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি বাড়ি (বীর নিবাস) বরাদ্দ নিয়ে এমন অভিযোগ করেছেন অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে একতলাবিশিষ্ট বীর নিবাস বরাদ্দ দেওয়া হয়। হরিরামপুর উপজেলায় ৩৯ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবারের নামে বীর নিবাস বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এ সুবিধাভোগী নির্বাচনবিষয়ক কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্বাচিত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, উপজেলা প্রকৌশলী ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা।

আবেদন করেও ঘর পাইলাম না। যাগো পাকা ঘরবাড়ি আছে, তাগোই ঘর বরাদ্দ হইছে! মৃত্যুর আগে পাকাঘরে থাকার স্বপ্ন আর পূরণ হইল না।
শেখ দাহের উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা

অসচ্ছল কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, বীর নিবাস যাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁদের কেউ সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতা, কেউ বিত্তশালী। পারিবারিকভাবে তাঁদের অনেকেই জমিজমাসহ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। অনেকের পরিবারের একাধিক সন্তান মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরিও পেয়েছেন। এ ছাড়া কানাডা, ইতালি ও আমেরিকায় নাগরিকত্ব পেয়েছেন, এমন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বীর নিবাস দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও চলতি ধাপের বীর নিবাসের তালিকায় উপেক্ষিত হয়েছেন অনেক অসহায়, দুঃস্থ ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবার।

উপজেলার ধূলশুড়া ইউনিয়নের গঙ্গারামপুর মৌজার আইলকুন্ডি গ্রামে বসবাস করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ দাহের উদ্দিন (৭২)। তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন। আর্থিক অনটনের কারণে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারেননি। জমিজমা বলতে শুধু ১৮ শতক বসতবাড়ি। বাড়িতে একটি চারচালা ও একটি দোচালা টিনের কাঁচাঘর।

দাহের উদ্দিন জানান, দুই বছর আগে বীর নিবাসের আবেদন করেন তিনি। ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে তদন্তও করা হয়। তবে বরাদ্দ তালিকায় তাঁর নাম নেই। তিনি বলেন, ‘৩০ বছর আগে নদীতে বাপদাদার ঘরবাড়ি নিয়া গেছে। এখন এইটুকু জায়গার মধ্যে কোনোরকমে দুইটা ঘর তুলে ছোট পোলার বউ বাচ্চাসহ আমরা স্বামী-স্ত্রী মাথা গুঁইজা আছি। আবেদন করেও ঘর পাইলাম না। যাগো পাকা ঘরবাড়ি আছে, তাগোই ঘর বরাদ্দ হইছে! মৃত্যুর আগে পাকাঘরে থাকার স্বপ্ন আর পূরণ হইল না।’

ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে ঘর তোলার জন্য জায়গা আছে কি না, তা তদন্তও করা হয়েছিল। তবে আমার ভাগ্যে জোটেনি বীর নিবাসের ঘর।
মকিম বিশ্বাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা

একই ইউনিয়নের রামেশ্বরপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সলিম মিয়াও বীর নিবাসের জন্য আবেদন করেছিলেন। তিনিও বরাদ্দ পাননি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, তাঁর দুই ছেলে বিয়ে করেছেন, তাঁদের আলাদা সংসার। সাত শতক জায়গার ওপর একটি চারচালা টিনের ঘরে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন।

নীলগ্রাম গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মকিম বিশ্বাসের (৮২) বাড়ি ছিল ধূলশুড়া ইউনিয়নেরই মধ্যতরা গ্রামে। প্রায় ৪০ বছর আগে জমিজমাসহ বসতবাড়ি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। পরে তিনি এই নীলগ্রাম গ্রামে ১৩ দশমিক ৫ শতক জায়গায় বাড়ি করেন। স্ত্রী এবং এক পালক ছেলেসন্তান নিয়েই বর্তমানে তাঁর সংসারজীবন। ছেলে দিনমজুরের কাজ করেন।

বাড়িতে জরাজীর্ণ দুটি কাঁচা ঘর। দীর্ঘদিন ধরেই মকিম বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে চলছে বৃদ্ধ দম্পতির সংসার। মকিব বিশ্বাস বলেন, ‘বীর নিবাসের জন্য আমিও আবেদন করেছিলাম। ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে ঘর তোলার জন্য জায়গা আছে কি না তা তদন্তও করা হয়েছিল। তবে আমার ভাগ্যে জোটেনি বীর নিবাসের ঘর।’

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার বয়ড়া ইউনিয়নের আন্ধারমানিক গ্রামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার (অসিত কুমার নাগ) বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া পাশের আরেকটি জায়গায় দোতলা পাকা বাসা করছেন। এরই মধ্যে ওই বাসার দোতলার ছাদ নির্মাণও সম্পন্ন হয়েছে। দুই ছেলের একজন সরকারি এবং অপরজন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি করেন। এক মেয়ে থাকেন কানাডায়। তিনি বীর নিবাসের ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। অসিত কুমার নাগ বলেন, ‘অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আমিও বীর নিবাসের জন্য আবেদন করেছিলাম। যাচাই–বাছাই করেই আমাকে একটি বীর নিবাস বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’

উপজেলা বীর নিবাস যাচাই–বাছাই কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, তাঁরা দ্বিতীয় ধাপে ৪৬ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাতজনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৯ জনের নামে বীর নিবাস বরাদ্দ হয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বীর নিবাস যাচাই–বাছাই কমিটির সভাপতি মো. শাহরিয়ার রহমান বলেন, তিনি এই উপজেলায় যোগদানের আগেই যাচাই–বাছাই কার্যক্রম হয়েছে। তবে পর্যায়ক্রমে সব বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর নিবাস পাবেন।