Thank you for trying Sticky AMP!!

শক্ত হাতে বৈঠা চালান সামাদ মাঝি। হাল ধরে থাকে তাঁর ছেলে সোহাগ। সম্প্রতি সিলেটের গোয়াইনঘাটে

কিশোর ছেলের চোখে পথ দেখে অন্ধ মাঝির বইঠা চলে

বর্ষকালে নৌকায় মানুষ পারাপার আর শুকনা মৌসুমে মাছ ধরে সংসার চলত আবদুস সামাদের (৩৭)। হঠাৎ এক ঘটনায় দুই চোখের আলো হারান। অন্ধ মাঝির নৌকায় ওঠা বন্ধ করে দেয় লোকজন। তবে থেমে থাকেননি সামাদ। এখন নৌকার আগায় বসে পথ দেখায় তাঁর ১৩ বছর বয়সী ছেলে সোহাগ আহমদ। আর শক্ত হাতে বইঠা বেয়ে মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেন সামাদ। এভাবে ছেলের সহায়তায় চলতে অক্ষম বাবা সক্ষম হয়ে ওঠেন।

জীবনসংগ্রামী এই অন্ধ মাঝি আবদুস সামাদের বাড়ি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের শিমুলতলা গ্রামে। গোয়াইনঘাটের জাফলং মূল সড়ক থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গিয়ে প্রথম ঘরটি আবদুস সামাদের। টিনশেডের ঘরে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার।

স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে প্রায়ই শিমুলতলা গ্রামে মূল সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। সে সময় যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। গ্রামের সবার ঘরে নৌকা নেই। যাতায়াতের জন্য অন্যের নৌকায় উঠতে হয় বাসিন্দাদের। আবদুস সামাদ সে সময় নৌকা চালিয়ে মানুষ পারাপার করেন। তাঁর সঙ্গে থাকে ছেলে সোহাগ আহমদ। পানি নেমে গেলে শুষ্ক মৌসুমে বাবা-ছেলে মিলে তখন মাছ শিকার করেন। মাছ শিকারেও ছেলে পথ দেখায়। জলাশয়ের কোথায় মাছের আধার, সেটি ছেলে তার বাবাকে জানালে বাবা-ছেলে মিলে শিকারে নামেন। এভাবেই চলছে তাঁদের সংসার।

কিশোর ছেলে হয়ে উঠেছে সামাদ মাঝির চোখের আলো। সম্প্রতি সিলেটের গোয়াইনঘাটে

সম্প্রতি শিমুলতলা এলাকায় গেলে নৌকায় পাওয়া যায় বাবা-ছেলেকে। পরে নৌকায় বসেই আলাপ হয়। আবদুস সামাদ জানান, প্রায় ১২ বছর ধরে নৌকা চালান তিনি। একসময় সামাদ মাঝি হিসেবে পরিচিতি পান। বছর পাঁচেক আগে একদিন রাতে নৌকা চালিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে বাড়ি ফেরার সময় চুরির অপবাদ দিয়ে আটক করা হয় তাঁকে। কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক তখন চোখে চুন ঢেলে দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। এরপর চিকিৎসা নিয়েও তিনি আর তাঁর চোখের আলো ফিরে পাননি।

দুই চোখের আলো হারিয়ে নৌকার মাঝিগিরি তো দূরের কথা, অন্য কোনো কাজ করতে অক্ষম ছিলেন। এ সময় কিছুদিন তাঁর স্ত্রী অন্যের বাড়িতে গৃহস্থালি কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। ছেলের বয়স ছয় থেকে সাত বছর হওয়ার পর তাকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় মাঝির কাজে ফেরেন। পাঁচ বছর ধরে নৌকায় মানুষ পারাপার করে ও মাছ শিকার থেকে আয় করেন। এসব কাজ অনেকটা নিজের ধারণা এবং ছেলের দিকনির্দেশনায় করেন। স্ত্রী ঘরে কিছু হাঁস-মুরগি পালন করেন।

অন্ধ এক ব্যক্তি অন্যের কাছে হাত না পেতে কাজ করেই আয় করছেন, সেটি স্বচক্ষে দেখে অভিভূত হয়েছেন। এটি অনেকের জন্য অনুপ্রেরণারও বিষয়।
তাহমিলুর রহমান, গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা

সামাদ-ফাতিমা দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। সবার বড় সোহাগ। এক মেয়ের বয়স আট বছর। আরেক মেয়ের বয়স আড়াই বছর। ছোট ছেলের বয়স এক বছরের কিছু বেশি। সোহাগ স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তবে এখন সে আর স্কুলে যায় না।

সোহাগ আহমদ জানায়, পড়ার ইচ্ছা থাকলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয় গ্রামের বাইরে হওয়ায় যাওয়া–আসায় সারা দিন চলে যাবে বলে পড়াশোনা বাদ দিতে হয়েছে। নৌকায় মানুষ পারাপারের সময় বাবা বইঠা চালান। সে কেবল নৌকাটি কোন দিকে যাবে, তা নির্ণয় করে। এতে কোনো সমস্যা হয় না। নৌকা পারাপারে ভাটা পড়লে তখন মাছ ধরা চলে একই কৌশলে। বিল শুকিয়ে গেলে সে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। বাবা বিলে হাতড়ে মাছ ধরেন। সে মাছগুলো সংগ্রহ করে। আবার নৌকা নিয়ে কখনো জাল দিয়ে বিলে গিয়ে মাছ ধরেন বাবা-ছেলে। সেগুলো বিক্রি করে চলে সংসারের খরচ।

Also Read: তিন পুরুষের পেশা, কীর্তিনাশা পারাপারে আজও পয়সা নেন না রমেশ মাঝি

বাবা–ছেলে মিলে নৌকা বেয়ে সংসার চালন। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার শিমুলতলা গ্রামে

আবদুস সামাদ বলেন, মনোবল ছিল নৌকা চালাতে পারবেন। কিন্তু মানুষ তাঁর নৌকায় উঠতে চাইত না। বিষয়টি ছেলে সোহাগকে জানানোর পর থেকে সে সঙ্গী হয়। তাঁর পাশে অথবা নৌকার আগায় বসে সোহাগ পথ দেখায়। এভাবেই নৌকা চালানো শুরু করেন। নৌকা চালনায় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটায় মানুষ আশ্বস্ত হয়। আগের মতো নৌকায় করে মানুষ পারাপার শুরু করেন।

শিমুলতলা গ্রামের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন (৩৫) বলেন, অন্ধ হওয়ার পর কখনো তিনি আবদুস সামাদকে হাত পাততে দেখেননি। স্বাভাবিক মানুষের মতোই নৌকা চালিয়ে ও মাছ শিকার করে সংসার চালান। সঙ্গে থাকা ছেলেই সামাদের চোখের আলো। তার সাহায্যেই কাজ করতে সক্ষম।

সামাদ মাঝির নৌকায় চড়েছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান। তিনি জানান, কয়েক মাস আগে শিমুলতলা এলাকায় পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকলে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সে সময় সামাদের নৌকায় তিনি উঠেছিলেন। অন্ধ এক ব্যক্তি অন্যের কাছে হাত না পেতে কাজ করেই আয় করছেন, সেটি স্বচক্ষে দেখে অভিভূত হন। এটি অনেকের জন্য অনুপ্রেরণারও বিষয়। সোহাগ তার বাবাকে সময় দিয়েও যদি পড়াশোনা করতে চায়, সে ব্যবস্থা করা হবে।

Also Read: পদ্মায় বইঠা বাইতে বাইতেই মাঝি হয়ে উঠেছেন আলোকচিত্রী, তুলেছেন ৪০০ প্রজাতির পাখির ছবি